কুমিল্লার ক,খ,গ

-"কীরে নাঈম, যাবি না?"

ভেতর থেকে কে যেন বারবার এইভাবে ডেকে ওঠে। ব্যাপারটা হয় কিছুদিন পরপরই। কোথাও না যেতে পারলে হাঁসফাঁস লাগে, অস্বস্তি হয়। অনেকদিন ধরেই কোথাও যাওয়া হচ্ছে না। এই গুমোট বাঁধা যান্ত্রিক মানুষের শহরে যেন তাতিয়ে উঠছি দিনের পর দিন। তাই ঠিক করলাম এবার "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে" নীতি অবলম্বন করা যাক।

যদিও কাউকে ডাকি নি এবার, কেননা এবার উদ্দেশ্যই ছিলো, "YOLO, Go Solo!"

গন্তব্য কুমিল্লার কোটবাড়ি, শালবন বিহার, ধর্মসাগর আর বিখ্যাত মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই। তাই ভোরেই ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে দিলাম কুমিল্লার উদ্দেশ্যে। কুমিল্লা ঢাকা থেকে কাছে হওয়ায় বেশিক্ষণ সময় লাগলো না। একা একা এই প্রথমবারের মতো ভ্রমণ করতে খানিক উত্তেজনা টের পাচ্ছি নিজের মধ্যে। ভালোই উপভোগ করছি। দেখতে দেখতে সাড়ে তিন ঘন্টার মাঝে পৌঁছে গেলাম কোটবাড়ি। সেখানে নেমে রাস্তার এপারের এক বিখ্যাত হোটেলে সকালের নাস্তাটা করে নিলাম পরোটা, ডালভাজি আর মিষ্টি দিয়ে। দোকানের নামটা আর মনে নেই তবে যে কেউ কোটবাড়ি নেমে সবার প্রথমেই হাতের বাঁ পাশে যেই হোটেলটা দেখবে সেটাই সেই হোটেল।

যাই হোক এবার এক্সপ্লোরেশনের পালা। বেরিয়ে পড়লাম শালবন বিহারের উদ্দেশ্যে। শালবন বিহার মূলত বৌদ্ধদের একটি প্যাগোডা যেখানে বৌদ্ধ ভিক্ষু বা সন্ন্যাসীরা থাকে। বিরাট বুদ্ধমূর্তি দেখে হঠাৎ মনে হলো, এরকম কোনো বুদ্ধ হয়তো আমার মধ্যেও জাগ্রত আর সেইকারণেই বোধহয় বাধাভাঙা জোছনা না পেলেও নিরুদ্দেশে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয় মাঝেমধ্যে। আচ্ছা, তার ডাকেই এসে পড়লাম না তো? কতকিছুই তো হয় এই ধরণীতে, তার কতটুকুই বা আমরা জানি।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে শালবাগানেই যে দুপুর গড়িয়ে এল তা টের পেলাম মানুষের সহাস্য কলরোলে। দেখলাম দুই অপরিচিত যুবক এগিয়ে আসছে আমারই দিকে। অজানা আশঙ্কায় মন খানিকটা বিচলিত হলেও মানিয়ে নিলাম এই ভেবে, "যা হয় দেখা যাবে!" এগিয়ে গিয়ে তাদের সাথে পরিচিত হয়ে জানতে পারলাম তারা দুইবন্ধুও আমার মতো এখানে এসেছে অন্য জায়গা থেকে। তাদের একজন ঢাকার বাসিন্দা আরেকজন ফেনীর। এই কুমিল্লা ট্রিপের পরিকল্পনা তাদের বহুদিনের। এক কথায়, দু'কথায় তাদের সাথে বেশ পরিচয় হয়ে গেল। যেন অনেকদিনের চেনা কেউ তারা আমার। তাই যখন তারা আমাকে একসাথে পুরো জায়গা ঘুরে বেড়ানোর প্রস্তাব দিলো, না করতে পারলাম না।

তারপর পরের ঘণ্টাদুয়েক যে কীভাবে কেটে গেলো তা আর বলতে পারবো না। সত্যিই বাপু, "Destination doesn't matter, company matters" দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে আমি তাদের প্রস্তাব দিলাম আমার সাথে ধর্মসাগর দেখতে আর মাতৃভাণ্ডারের মিষ্টি খেতে যেতে। তারা বললো তাদের দেরি হয়ে যাবে। অগত্যা বিদায়ের পালা ঘনিয়ে এলো। এক অন্যরকম অভিজ্ঞতায় পূর্ণ হলো আমার ঝুলি। সম্পূর্ণ অপরিচিতদেরও যে এইভাবে আপন করে নেয়া যায়-এতদিন পর্যন্ত এ ছিলো আমার জ্ঞানের বাইরে।

এখান থেকে আমার সত্যিকারের সোলোট্রিপ শুরু হয়। সূর্য ততক্ষণে মাথার ওপর থেকে ঢলে পড়তে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। আমি ক্যান্টনমেন্ট থেকে মাতৃভাণ্ডারের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। কুমিল্লায় যেই পরিমাণ নকল মাতৃভাণ্ডার আছে তা দিয়ে গোটা দেশকে রসমালাইয়ের রসে চোবানো সম্ভব বলে আমার ধারণা। তবে আসল মাতৃভাণ্ডার খুঁজে পেতে হলে আপনাকে আমার মতো যেতে হবে মনোহরপুরে। সেখানে গেলেই কেবলমাত্র আপনি আদি ও অকৃত্রিম মাতৃভাণ্ডারের খোঁজ পাবেন। যাইহোক, পৌঁছে দেখি সারি ধরে মানুষ তাদের মিষ্টি নিচ্ছে। ওখানে রসমালাই ছাড়াও আরো নানা ধরনের মিষ্টি পাওয়া যায়। ওখান থেকে রসমালাই নিয়ে আমি শেষ বিকেলের সূর্যাস্ত উপভোগ করার জন্য ধর্মসাগর রওনা দেই। ধর্মসাগরের প্রচুর ভিড় হয় বিকেলে। প্রচণ্ড মানুষের ভিড়ে বসেও আজকের সারাদিনের কথা ভেবে বেশ ভালোই লাগতে থাকে। পড়ন্ত সূর্যের আলোকচ্ছটা দীঘির বিশাল জল বিচ্ছুরিত করে যাচ্ছে সোনালী আভা দিয়ে।

বিদায় জানিয়ে সন্ধ্যার পর ফেরত আসতে শুরু করি শহরের সেই চিরাচরিত জীবনে। ফের।