বর্ণিল ও বৈচিত্রময় এই বঙ্গ জীবনে

দূর থেকে ভেসে আসছে মুয়াজ্জিনের আযানের ধ্বনি। একটি দুটি করে আস্তে আস্তে জেগে উঠে পুরো বাংলার গ্রাম ও নগরজীবন। সপ্তাহের শুরু কিংবা শেষ, গ্রাম বাংলার জীবনের শুরুটা হয়ে যায় খুব ভোরে। একটু একটু করে যখন আলো ফোটা শুরু হয় তখন চোখে পরে দল বেধে শিশুদের মসজিদ বা স্কুলে যাওয়ার দৃশ্য কিংবা লাঙ্গল-কাস্তে হাতে নিয়ে কৃষকদের মাঠে যাবার দৃশ্য। চারদিকে সবুজের মাঝে যখন আলো ছড়িয়ে পরে গ্রামবাংলার স্নিগ্ধ রুপ চোখে এসে ধরা দেয়। নগর জীবনের ব্যস্ততাও থেমে থাকে না। চারদিকে ব্যস্ত মানুষের ছোটাছোটি, দীর্ঘ ট্রাফিক, হরেক রকম মানুষ আর হরেক রকম শব্দ যেন জানান দেয় প্রতিদিনের ব্যস্ত নগর জীবনকে আলিঙ্গন করে নিতে। একই বাংলায় জীবনের ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্য আমাদের বুঝিয়ে দেয় বাংলাদেশের মানুষের বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময় জীবনের কথা।

মায়ের সাথে সন্তানের যেমন নাড়ির সম্পর্ক, গ্রাম বাংলার মানুষের এদেশের প্রকৃতির সাথে সম্পর্কটা যেন ঠিক সেরকম। বাংলার প্রকৃতি ও মাটির উপর গ্রাম বাংলার মানুষের অগাধ ভালবোবাসা ও শ্রদ্ধা যুগ যুগ ধরে। আর তার প্রতিফলন চোখে পড়ে মাটির ঘরগুলো দেখে। এক একটা মাটির ঘর সাক্ষী দেয় এদেশের গ্রাম বাংলার মানুষের সহজ সরল জীবনের কথা। কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে গ্রাম বাংলার মানুষ বিভিন্ন পেশা বেছে নিলেও অধিকাংশ গ্রামবাসির জীবন ও জীবিকা কৃষি কাজে নির্ভর করে। তাদের জীবনটা শুরু হয়ে যায় খুব ভোর সকালে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তারা শুধু নিজের পরিবারের অন্ন যোগায় না; তারা অন্ন যোগায় এদেশের ষোল কোটি মানুষের। এক এক জন কৃষক তাদের স্বপ্ন বুনে দেয় মাটির মাঝে। এই বাংলার মাটি, নদী, পুকুর কিংবা পথঘাট; প্রকৃতির সর্বত্র জায়গায় যেন তাদের জীবন ছড়িয়ে রয়েছে। জীবন থেকে তাদের চাওয়া এই চির সবুজের মাঝে যাতে পরিবার নিয়ে শান্তির নীড়ে থাকতে পারে সব সময়। গ্রাম বাংলা ও তার মানুষের এই সবুজ-সারল্যে ভরা জীবন বাংলাদেশকে করে তুলে ভীষণ মায়াময়।

গ্রাম পেরিয়ে যখন শহরের দিকে যত এগুতে থাকি বাংলাদেশ যেন আস্তে আস্তে সবুজ থেকে ধূসর বর্ণ ধারণ করতে থাকে। কংক্রিটের বাড়ি, নানারকম গাড়ি, ট্রাফিকের দীর্ঘ লাইন, চারদিকে ছুটতে থাকা নানা পেশার মানুষ জানান দেয় বাংলাদেশও সামনের দিকে ছুটে চলছে। গভীর রাত পর্যন্ত চলতে থাকে শহুরে জীবনের ছুটে চলা। আর এই ব্যস্ত জীবনকে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আলিঙ্গন করে নেয় বাংলার মানুষ। তবে এই ব্যস্ত ও ধুসর শহরগুলোতে কখনো কখনো রঙের ছটা নেমে আসে। বারো মাসে তের পার্বণের এই বাংলায় যেকোনো উৎসব পালন হয় বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবেই। এই সময়গুলোতে বাংলাদেশের বর্ণিল জীবনের চিত্রগুলো চোখে ধরা পরে। পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু করে পহেলা ফাল্গুন, ঈদ, পূজা সব উৎসবেই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পুরো দেশের মানুষ এক হয়ে উঠে আনন্দ উদযাপনের জন্য। প্রতিদিনের ছুটে চলার মাঝে যেখানে কারও দিকে ফিরে তাকানোর সময় পাওয়া যেত না, সেখানে এই উৎসব গুলো সবাইকে যেন এক করে দেয়। ব্যস্ত নগর জীবনে মাঝে মাঝে নেমে আসা এই সকল বর্ণিল উৎসবের মাঝেই যেন জীবনের স্বস্তি খুঁজে পায় মানুষ।

নগর কিংবা গ্রাম বাংলার জীবনই যে কেবলমাত্র বাংলাদেশের জীবনকে বৈচিত্র্যময় করে তুলে তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন অঞ্চল কিংবা ঋতুভেদেও এদেশের মানুষের বিভিন্ন রূপ চোখে পড়ে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড খরতাপে কোঠর হয়ে যাওয়া মানুষের জীবন স্বস্তি ফিরে পায় বর্ষায়। শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘদের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলা জীবন হেমন্তের নবান্ন উৎসবে খনিকের জন্য বিরতি নেয়। শীতের রুক্ষ ও মলিন জীবনে মায়ের হাতের ভাপা পিঠা যেন একটুখানি উষ্ণতা এনে দেয়। শীতের ধূসর মলিন জীবন শেষে বসন্তে আবার বাংলাদেশের মানুষ যেন বর্ণিল রুপে সজ্জিত হয়। শহর ও গ্রাম পেরিয়ে এদেশের মানুষের জীবনের ভিন্ন রকম ধারা আবার দেখা যায় পূর্বের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে। রাঙ্গামাতি, খাগরাছড়ি, বান্দরবনের মত উঁচু উঁচু পাহাড়ে থাকা আদিবাসীদের মন যেন এদেশের মাটির মতই সহজ সরল। পাহাড়গুলো যেন তাদের মিতা। এই পাহাড় বেয়েই তাদের জীবন চলে পথ যতই বন্ধুর হোক না কেন।

জীবন যেখানেই থাকুক না কেন এদেশের মানুষ সংগ্রাম করে বেঁচে থাকায় বিশ্বাসী। আর এদেশের মানুষের জীবন সংগ্রামের ইতিহাস বহু যুগ পুরনো। যত দুর্যোগই আসুক না কেন, বাংলাদেশের মানুষ মাথা ঘুরে দাঁড়াতে জানে। তার বাস্তব উদাহারণ চোখে পড়ে পদ্মার পারে থাকা মানুষগুলোকে দেখে, যখন নদী ভাঙন তাদেরকে দুমরে-মুচরে দেয় তবুও তারা নতুন জীবনের আশায় বুক বেঁধে নতুন করে ঘর বাঁধে। সুন্দরবন কিংবা কক্সবাজারে প্রায় প্রতি বছর দুর্যোগে আহত হওয়া মানুষের হার না মানা মনোভাব বুঝিয়ে দেয় বাধা- বিপত্তি যত আসুক, আমরা নতুন উদ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে জানি।

আর মানুষের এই সকল ধরনের জীবনসংগ্রাম, বাধা-বিপত্তির মাঝে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি আসে এদেশের মানুষের ভালবাসতে পারার শক্তি থেকে। বাংলাদেশের মানুষ ভালবাসতে জানে প্রচণ্ড ভাবে। তাই হয়ত এদেশের মানুষ ভালবাসার প্রকাশ মুখের চেয়ে কাজে প্রকাশ করতে বেশী পছন্দ করে। বাবারা হয়তো এক পাঞ্জাবীতে কাটিয়ে দিবে বছরের পর বছর কিন্তু নিজ সন্তানকে প্রতি ঈদে নতুন জামা দেয়ার জন্য যেন বদ্ধ পরিকর থাকে। ভালবাসার চিহ্ন সেসব মায়েদের চোখে দেখা যায়, যখন তারা তাদের সন্তান্দের জন্য পছন্দের খাবারটি প্রবল উদ্যমে রান্না করে। ছোট কিংবা বড় ভাই-বোনের উষ্ণ আদর ঘিরে রাখে একে অপরকে। কার্ড কিংবা চিঠির মাধ্যমে ভালবাসার প্রকাশের চলন না থাকলেও এদেশের মানুষ একে অপরকে ভালবেসে যায় নিঃশব্দে। পরিবার তাই এদেশের মানুষের শক্তির এক বড় উৎস। সারা দিনের সকল ক্লান্তি-ধকল যেন এক নিমিষে শেষ হয়ে যায় পরিবারের হাসি মুখ দেখে আবার এই পরিবারের প্রিয় হাসিমুখ ধরে রাখার জন্য জীবন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরে পরেরদিন।

প্রকৃতি, পরিবার, মানুষজন সব কিছু নিয়েই ঘিরে আছে বাংলাদেশের মানুষের জীবন। কখনও কখনও হয়তো জীবনে দুর্যোগের ঘনঘটা দেখা দেয় আবার কখনো কখনো রঙধনুর ন্যায় বর্ণিল থাকে। নগর কিংবা গ্রাম, পাহাড় কিংবা সমুদ্র যেখানেই থাকুক না কেন এদেশের মানুষ জীবন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধাবোধ করে না। আর তাই এদেশের মানুষ ভালবাসতে জানে নিজের দেশেকে, দেশের মানুষকে। একই দেশের মাটিতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একে অপরকে ভালবাসা ও শ্রদ্ধায় সিক্ত করে বাংলাদেশের মানুষ যেন বলে দেয় বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময় জীবনে বেঁচে থাকার সুখ-দুঃখের কথা।