ইবনে বতুতার ধূসর টানা, ঈশা খাঁর রাজ্যে আনাগোনা

শুরু করছি ইবনে বতুতার বিখ্যাত একটি উক্তি দিয়ে। তিনি বলেছেন- " ভ্রমণ প্রথমে তোমাকে নির্বাক করে দেবে তারপর তোমাকে গল্প বলতে বাধ্য করবে।" কথাটার মমার্থ আজ হাড়েহাড়ে বুঝতে সমর্থ হয়েছি। চোখে এডভেঞ্চারের চশমা লাগিয়ে ঘুরেছি কত শত জায়গা। চন্দ্রনাথ বা কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় সগৌরবে দাড়িয়ে বলেছি," বল বীর, চির উন্নত মম শির।" তবে আজকে লিখব এক ঐতিহাসিক স্থানের স্মৃতির আলপনায় আকাঁ এক ভিন্ন রকম ভ্রমণের গল্প। ছোটবেলায় ক্লাস এইটে পড়ার সময় প্রথমবার গিয়েছিলাম সোনারগাঁওয়ে। এরপরে আরও বহুবার গিয়েছি। কিন্তু প্রথম ভ্রমণটাতেই ধূসর মেঘপুঞ্জের মত হয়ে আছে মজার কিছু স্মৃতি। ভুলবার নয় সেই স্মৃতি। রিমঝিম বৃষ্টি, তারপর লিপিকার সাথে দেখা। আরও কত কি!

আস্তে আস্তে বলি। তার আগে বলে নেই, সোনারগাঁও ঢাকা থেকে ২৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। তবে আমরা গিয়েছিলাম নারায়ণগঞ্জের বন্দর থেকে। দুই ঘণ্টার রাস্তা। মধ্যবিত্ত ঘরের কিশোর আমরা। অনেক কষ্টে দুশো টাকা করে যোগাড় করি সাতজন বন্ধু মিলে। ভাড়া করি মধ্যমমানের একটা অটো রিকশা। পেছনের দুইপাশে তিনজন করে ছয়জন। আর সামনে ড্রাইবার চাচার সাথে আমি।সকাল আটটার দিকে রওনা দেই আমরা।আমরা চিনি না, যাই-ও নি কখনও। তবে চাচা চিনেন সবকিছু। মুখে হাসি আর আনন্দকন্দে পূর্ণ মন নিয়ে আমরা সাতজন কিশোর রওনা দেই সোনারগাঁওয়ের পথে। বইয়ে পড়েছি, ঈশা খাঁর রাজধানী ছিল সোনারগাঁও। ঈশা খাঁর স্ত্রী সোনাবিবির নামে সোনারগাঁও এর নামকরণ করা হয়। অতৃপ্ত মন তাই সাগ্রহে ছুটে চলছে তার তৃষাতুর মনকে পরিতৃপ্ত করতে।

সকাল দশটার ঠিক দশ মিনিট আগে আমরা পৌঁছে যাই সোনারগাঁওয়ের গেইটে। তবে এখন বাঁধে এক সমস্যা! সবাই আমরা গাড়ি থেকে নেমেছি ঠিকই। কিন্তু 'দিলওয়ালের বাচ্চাকে' কোলে নেয় নি কেউ। দিলওয়ালের বাচ্চা কোন বাচ্চা নয়। সবাই মিলে বিরিয়ানির একটা বড় ওভেন এনেছি সাথে, দুপুরে খাওয়ার জন্য। সেই ওভেনের নামই দিলওয়ালের বাচ্চা। অগত্যা আমিই হাতে নিলাম। চলে এসেছি স্বপ্নের সোনারগাঁওয়ে। টিকেট কিনে ঢুকতেই চোখে পড়লো ঈশা খার জমিদার বাড়ি যা বড় সরদার বাড়ি নামে পরিচিত। সোনারগাঁওয়ের আরেকটি পরিচয় হলো এখানেই অবস্থিত শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর। সামনে হাটতেই দেখি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের "সংগ্রাম" চিত্রটির ভাস্কর্য। পঞ্চাশ টাকার টিকেট কিনে মনে হচ্ছে এ যে এক স্বর্গীয় রাজ্যে চলে এসেছি। দিলওয়ালের বাচ্চাকে ধরিয়ে দিলাম মেহেদির হাতে। সুন্দর ও স্নিগ্ধতার চাদরে মোড়ানো চারদিকটা। পূর্বদিকে তাকাতেই চোখে পড়ে গেলো হাজারো বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি। সামনে হেটে বামে গিয়ে দেখি লাইব্রেরি। আমি আর সিজু প্রবেশ করলাম লাইব্রেরিতে। কত বই! সিজু খুব জোরে জোরে শব্দ করতে লাগলো। তখনই একজন বৃদ্ধ লোক এসে বললো- লাইব্রেরিতে শব্দ করতে হয় না আস্তে আস্তে বই পড়তে হয়। ও খুব লজ্জা পেলো। আমি হাসছি ওর কান্ড দেখে। কবি জসীমউদ্দিনের 'ডালিম কুমার ' বইটির দুই তিন পৃষ্ঠা পড়ে দু'জনে বের হই। সামনেই সরোবর। কি সৌন্দর্যে ঘেরা প্রাকৃতিক দৃশ্য। আবার ফিরে আসি আমরা বড় সরদার বাড়িতে। কত ঢাল, তলোয়ার, প্রাচীন আসবাব কত পুরাতন জিনিস সংরক্ষিত আছে সেখানে। প্রতিটা পুরাকীর্তিতেই লিখা ছবি তোলা নিষেধ। কিন্তু দেখলাম এর উল্টো কাজটি করতে সবাই ব্যস্ত। দেখতে দেখতে সাড়ে বারোটা বেজে গেলো। বৃষ্টি ঝরছে নীল আকাশের বুক থেকে। দিলওয়ালের বাচ্চাকে খাবার পালা এবার। উত্তর দিকের একটা যাত্রী ছাউনি ফাঁকা।

আমি, সিজু, সায়েম, প্রান্ত, রিয়াজ, সিফাত এবং মেহেদি - সাতজনে বসে খাওয়া শুরু করি। খাবার পরিবেশন করছে রিয়াজ।হঠাৎই একটা সাত বছরের পিচ্চি মেয়ে এসে বলে- ফুল নিবেন ফুল? আমি জিজ্ঞেস করি কি ফুল। ও উত্তরে বলে কদম ফুল। বর্ষার কদম ফুল নিবেন। একটা ফুল দশ টাকা। খুব বড়বড় ফুল দেখছি। আমার ফুলের প্রয়োজন না থাকলেও মেয়েটির মায়াবী চেহারার অসম্ভব সুন্দর হাসিটা দেখার জন্য বিশ টাকা দিয়ে দুটো ফুল কিনে নিলাম।জিজ্ঞেস করলাম - তোর নাম কি? খাবি আমাদের সাথে। ও ঝটপট উত্তর দেয় খামু না। আমার নাম লিপিকা। অনেক চেষ্টা করলাম খাওয়াবার জন্য। কিন্তু খেলো না কিছুই। বৃষ্টি থামছে না এখনও। মেয়েটার সাথে গল্প করে জানতে পারি - নানী ছাড়া আপন কেউ নেই ওর। ফুল বিক্রি করে জীবন চালায়, কারও দান বা দয়ায় বেঁচে থাকতে চায় না। মনে হচ্ছিল ওর মধ্যে দেখতে পাচ্ছি সংগ্রামী আত্মনির্ভরশীল বাঙালি চেতনার বহিঃপ্রকাশ। খাওয়া দাওয়া শেষে জাদুঘরের আঙিনায় ছুটে চলি আমরা। প্রাচীন আমলে এই এলাকার মানুষদের গ্রাম চিত্র, তাদের ব্যবহার্য আসবাব, খাট- পালঙ্ক, ধান মাড়াইয়ের যন্ত্র - আরও কত কি দেখলাম। তারপর চলে গেলাম মেলায়। মাটির ঘর দেখতে কি সুন্দর! কত পুতুল, একতারা, মাটির হাড়ি পাতিল। যা-ই দেখছি,তাই কিনতে ইচ্ছে করছে। একটু সামনেই জামদানী শাড়ির দোকান। ঘুরে ঘুরে আরও অনেক কিছুই দেখলাম যেমনঃ সোনাবিবির মাজার, পাঁচবিবির মাজার, গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের সমাধি, ইব্রাহীম দানিশমান্দ-এর দরগা ইত্যাদি। সরোবরে দেখলাম পানকৌড়ি পাখি। বৃষ্টিতে ভিজে গেছে ধূসর ডানা। মন বলে উঠলো- ইবনে বতুতার ধূসর ডানা, ঈশা খাঁর রাজ্যে আনাগোনা। ওরা সবাই হাসতে হাসতে কাহিল। চাচা ফিরবে একেবারে বিকেল পাঁচ টার পরে।এখন আড়াইটা বাজে মাত্র। সেখান থেকে আরেকটা অটোরিকশা নিয়ে চলে আসি পানাম নগরে। এই পানাম নগর ১৯শ শতকে সোনারগাঁওয়ের উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ীদের বাসস্থান ছিল। সেখানে ৫২ টা ইমারত দেখতে পেলাম। তবে ইমারত গুলোর অবস্থা খুব করুণ। তাই বেশ কয়েকটি ইমারতেই ' বিপদজনক ' সাইনবোর্ড টানানো দেখতে পেলাম। পানাম নগরের মূল প্রবেশ পথের ছোট্ট খালটির উপরে একটি সেতু ছিলো, যার কোনো অস্তিত্ব আর অবশিষ্ট নেই আজ। অযত্ন আর অবহেলায় পানাম নগরের বাড়িঘরগুলোতে শ্যাওলা ধরেছে, ভেতরের পরিবেশটা স্যাঁতস্যাঁতে, গুমোট। পানাম নগরে ১৩০৫ সনের কাশীনাথ ভবন দেখে খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম আমরা। একটি গল্প ওঁ শুনেছি সেখানে গিয়ে। একবার পারস্যের খ্যাতিমান কবি হাফিজ-কে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তৎকালীন বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ। বৃদ্ধ কবি হাফিজ সে আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে আসতে না পেরে একটা গজল রচনা করে উপহার পাঠান সুলতানকে। এই গজলের সূত্র ধরেই ফার্সি এক পর্যটক এসেছিলেন সোনারগাঁ-তে, আর মুগ্ধ হয়েছিলেন পানাম নগরীর সৌন্দর্য্য দেখে। আসলেই সোনারগাঁওয়ের সৌন্দর্য অকহতব্য। মনে হচ্ছে ভ্রমণটা সার্থক হলো। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তাই বলিঃ

" বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।
দেশে দেশে কত-না নগর রাজধানী—
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,
কত-না অজানা জীব, কত-না অপরিচিত তরু
রয়ে গেল অগোচরে"।

তাইতো আজও বারবার মন ছুটে যেতে উদ্যত হয় সোনারগাঁওয়ের আদরে ঘেরা নন্দনকাননে। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের ধূসরতায় আবদ্ধ হবার আগেই আমরা চলে আসি সোনারগাঁওয়ের জাদুঘরের মূল গেইটে। এসে দেখি চাচা এসে গেছে। পুলকিত হৃদয় ও হাসি মুাখা মুখ নিয়ে উঠে পড়ি অটোরিকশাতে।তবে এবার আমি বসেছি পেছনের সিটে। ফিরে যাবার আগে বারবার তাকিয়ে ছিলাম সেই নন্দন কাননে। ইচ্ছে করছে ইবনে বতুতা হয়ে পানকৌড়ির ধূসর ডানার ঝাপটিয়ে আবার ফিরে চলি ঈশা খাঁর রাজ্যে।