আমি সবসময় হাঁসের ব্যক্তিত্ব ছিলাম। পানির উপরে শান্ত, পা নিচে পাগল হয়ে যাচ্ছে।

তিনি হয়তো ঠিকই বলেছেন, তাই হয়তো আমার মনের বাহিরের দিকটা শান্ত থাকলেও ভেতরের দিকটা সব সময় ভ্রমণ ও প্রকৃতির দিকে ছুটে যেতে চায়। আমি ভ্রমণপ্রিয় ও প্রকৃতিপ্রেমী একজন মানুষ। প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের কাছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড-মিরসরাইয়ের মায়া কাটানো কখনো সম্ভব না। আর এই মায়ার কাছে আমিও ধরা দিয়েছি বহুবার। আপনারা হয়ত জেনে অবাক হবেন যে, দেশের প্রায় ২০ শতাংশ ঝর্ণার অবস্থান এই সীতাকুণ্ড-মিরসরাই রেঞ্জে। আর এই সীতাকুণ্ডের অনন্য এক প্রাকৃতিক নিদর্শনের নাম খৈয়াছড়া ঝর্ণা। আজ আপনাদের শোনাবো আমার খৈয়াছড়া ঝর্ণার রোমাঞ্চকর এক ভ্রমণ কাহিনী।

গত বর্ষার কথা,সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ঢুকলেই চোখে পড়তো বিভিন্ন ট্রাভেল গ্রুপগুলোর ঝর্ণা নিয়ে মুখোরোচক পোস্ট ও লেখালেখি। এ সকল লেখালেখি দেখেই আমারও ইচ্ছে হয় যে, হুট করে কোথাও ঘুরে আসি। আমার আবার হুটহাট ঘুরে আসার পাগলামি রয়েছে। তো যেই ভাবা সেই কাজ, একদিনের মধ্যে প্ল্যান করে পরদিনই খৈয়াছড়া ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি। আমার সফরসঙ্গী হয় আমার বড় ভাই এবং আমার ভাইয়ের একজন বন্ধু। সেদিন আমরা সকাল সাতটায় বেরিয়ে চট্টগ্রামের একেখান বাস টার্মিনাল থেকে আটটার বাসে রওনা দেই। মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া বাজার পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঘড়িতে তখন ৯ টা বেজে ১৫ মিনিট। মিরসরাই নেমেই আমাদের সিএনজি ভাড়া করতে হয়,সিএনজি আমাদের খৈয়াছড়া ঝর্ণার পার্কিং পর্যন্ত নিয়ে যায়। তার পাশেই রয়েছে কিছু মধ্যম মানের রেস্টুরেন্ট,তারা আমাদেরকে অফার করলো আমরা যেনো জামা কাপড় এখানে চেঞ্জ করে আমাদের ব্যাগগুলো তাদের দায়িত্বে রেখে যাই। তাদের কাছে আমাদের ব্যাগ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর সেফটি নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। আমরা সেই একই রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবারের অর্ডার দিয়ে শুরু করি আমাদের মুল ট্র্যাকিং।

শুরু হচ্ছে ট্রাকিং
চিত্রঃ শুরু হচ্ছে ট্রাকিং

তবে যেহেতু আমরা বর্ষায় এসেছি তাই কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই দুর্গম খৈয়াছড়া ট্রেইল শুরু করতে হচ্ছে। আমাদের সেফটির জন্য খুঁটি হিসেবে চিকন বাঁশ কিনে নেই। যার দাম পড়েছিল ১০ টাকা, কিন্তু হ্যাঁ আপনি যদি ট্রাকিং শেষে আবার লাঠিগুলো ফেরত দিয়ে যান তাহলে আপনি আবার ৫ টাকা ফেরত পাবেন। খৈয়াছড়া ঝর্ণা এর মূল ট্রেকিংয়ে যতই এগুতে থাকবেন,আপনি ততোই স্রষ্টার অপরূপ সৃষ্টিতে মন্ত্রমুগ্ধ হতে বাধ্য হবেন। কারণ একই সাথে আপনি এই ট্রেকিংয়ে পেয়ে যাবেন গ্রামীণ পরিবেশ, পাহাড়ি ঝিরিপথ, পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তা যা আপনাকে নিয়ে যাবে লোকালয় থেকে অনেক দূরে নির্জন ও গা ছমছমে এক নতুন অভিজ্ঞতায়। যেতে পথে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে চারপাশে অন্ধকার হয়ে আসে,যার সৌন্দর্য ট্রেকিংয়ে এক নতুন মাত্রা যোগ করে।

আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে চারপাশ অন্ধকার
চিত্রঃ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে চারপাশ অন্ধকার

মেঘাচ্ছন্ন পরিবেশে পাহাড়ি ঝিরি পথের পানির কলকল ধ্বনি শুনতে শুনতে আমরা এগিয়ে চলছি। আপনারা হয়তো জেনে থাকবেন বর্ষায় ঝর্ণার আসল রূপ দেখা যায় এই যাত্রায় আমাদের কপালটা ভালো ছিল। ট্রেকিং এর অর্ধেকটা পথ এগোতেই শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি, বৃষ্টি খুবই,উপভোগ্য ছিল যা আমি বলে বুঝাতে পারব না। আপনাকে এই বৃষ্টির উন্মাদনা বুঝতে হলে বর্ষায় অন্তত একবার হলেও খৈয়াছড়া ভ্রমণ করতে হবে। কিন্তু, পাহাড়ি পথ বৃষ্টির কারণে অনেক বেশি পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত হয়ে যাচ্ছিল যা আমাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছিল।

খৈয়াছড়ার দুর্গম পথ
চিত্রঃ খৈয়াছড়ার দুর্গম পথ

বৃষ্টির মধ্যে প্রায় ৫০ মিনিট ট্রাকিং করে অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে আমরা শেষমেষ খৈয়াছড়া ঝর্ণার প্রথম ধাপে পৌঁছে যাই। ওহ! আপনাদের তো বলাই হয়নি,এখানে ঝর্ণার অনেকগুলো ধাপ রয়েছে। কেউ বলে সাতটা, আবার কেউ বলে এগারোটা ঝর্ণা রয়েছে। প্রথম ধাপে গিয়ে যা দেখলাম এর সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়, ঝর্ণার হিম শীতল পানিতে আমাদের ক্লান্তিগুলো এক নিমিষেই শেষ হয়ে গেল।

ঝর্ণার হিম শীতল পানিতে আমাদের ক্লান্তিগুলো এক নিমিষেই শেষ হয়ে গেল

মনে পড়ে গেল সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের “ঝর্ণার গান” কবিতার লাইন, ঝর্ণা হয়তো আমাদের বলছে-
গরজ যার জল স্যাঁচার
পাতকুয়ায় যাক না সেই,
সুন্দরের তৃষ্ণা যার
আমরা ধাই তার আশেই।

সেদিন সত্যিই খৈয়াছড়া ঝর্ণার অপরূপ সৌন্দর্যে দুচোখের তৃষ্ণা মিটিয়েছিলাম। এক কথায়,খৈয়াছড়া ঝর্ণার অপরূপ সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। যেহেতু এই ঝর্ণার অনেকগুলো ধাপ রয়েছে তাই, আমরা তিনজন চাইলাম আরো কিছু ধাপ উপরে উঠবো। কিন্তু, আমাদের জন্য দ্বিতীয় ধাপে ওঠা একটু কষ্ট সাধ্য হয়ে গিয়েছিল । কারণ, দ্বিতীয় ধাপে উঠতে হলে আমাদের ৮০°(প্রায়) খাড়া এবং কর্দমাক্ত পাহাড় উঠতে হবে। এবং দুর্ভাগ্যবশত আমাদের কাছে কোন দড়ি/রশি ছিলনা।

খৈয়াছড়া ঝর্ণার ধাপ
চিত্রঃ খৈয়াছড়া ঝর্ণার ধাপ

কিন্তু একটি প্রবাদ বাক্য রয়েছে,"ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়"। ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আমাদের ইচ্ছাশক্তির বলে আমরা গাছের শেখর ধরে ধরে আস্তে আস্তে দ্বিতীয় ধাপে উঠছিলাম। আমরা যেহেতু তিনজন ছিলাম, তাই প্রথমজনের পদক্ষেপ লক্ষ্য করে আমরা বাকি দুজন উঠছিলাম। প্রচন্ড ভয় হচ্ছিল কারণ, পা পিছলিয়ে যদি আমরা কেউ পড়ে যাই তাহলে বড়োসড়ো একটি দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

কথায় আছে,"সবুরে মেওয়া ফলে" এই বিখ্যাত প্রবাদ বাক্য টা মনে করে করে আমরা উঠছিলাম। একটু উঠার পর গাছের লতা-পাতার মাঝখান দিয়ে দেখতে পেলাম খৈয়াছড়া ঝর্ণার দ্বিতীয় ধাপ। ১২০ ফুট(প্রায়) উঠার পর এই দৃশ্য দেখে আমাদের মনে প্রচন্ড শান্তি অনুভব হল । মনে হল যেনো, মরুভূমিতে ঠান্ডা ও মিষ্টি পানির খোঁজ পেলাম। ঝর্ণার দ্বিতীয় ধাপটি দেখে আমরা এত আনন্দিত হয়েছিলাম যে সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।

খৈয়াছড়া ঝর্ণার দ্বিতীয় ধাপ
চিত্রঃ খৈয়াছড়া ঝর্ণার দ্বিতীয় ধাপ

এর সৌন্দর্য অতুলনীয়। দ্বিতীয় ধাপটি থেকে আমরা মোট তিনটা ধাপ একি সঙ্গে দেখতে পারি। তার মানে, এই একই জায়গায় আপনি দ্বিতীয়,তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপ দেখতে পারবেন। আমরা একই সাথে এমন তিনটি ধাপের ঝর্ণা কখনো দেখিনি। কি অপরূপ দৃশ্য, ইচ্ছে করছিলো যেন তাকিয়েই থাকি। একই সঙ্গে তিনটি ঝর্ণা একত্রে দেখাটা ছিল আমাদের জীবনের নতুন একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা। খৈয়াছড়া ঝর্ণা কে বাংলাদেশের ঝর্ণার রানী বলা হয়, কেন বলা হয়,তা ঝর্ণার সামনে দাঁড়িয়ে বুঝে নিতে আমার বিন্দুমাত্র সমস্যা হয়নি। নিজেকে ঝর্ণায় বিলিয়ে দিয়ে ও ঝর্ণার অফুরন্ত পানির ফোয়ারা দেখতে দেখতে কখন ২ ঘন্টা পেরিয়েছে বুঝতেই পারিনি। দ্বিতীয় ধাপটি তে আমরা তিনজন বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। ইচ্ছে ছিল চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপেও যাবো কিন্তু সেবার এত বৃষ্টি পড়েছিল যে চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপে যাবার রাস্তা অনেক বেশি পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিল । তাই আমরা আর যাওয়ার সাহস করিনি । বৃষ্টি যেন থামার নাম নিচ্ছিলো না। আমরা দ্বিতীয় ধাপে সময় কাটানোর পর, বৃষ্টি কিছুটা থামলে আমরা যে রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম সে রাস্তা দিয়ে আবার আসার সিদ্ধান্ত গ্রহন করলাম। কারণ পাহাড়ি পথ বৃষ্টির জন্য আরও বেশি মারাত্মক পিচ্ছিল হয়ে যায়।

ইচ্ছে না থাকা সত্বেও আমাদের খৈয়াছড়া ঝর্ণা কে বিদায় বলতে হবে। আমার তো ইচ্ছেই করছিল না আসতে। তবে আজ থাক! আবার আসবো এবং খৈয়াছড়া ঝর্ণার শেষ ধাপ পর্যন্ত যাবো। আসার পথে খৈয়াছড়া ঝর্ণার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। যাইহোক খৈয়াছড়া ঝর্ণার প্রথম ধাপ থেকে আবার খৈয়াছড়া পার্কিং এর দিকে যাত্রা শুরু করলাম।

খৈয়াছড়া পার্কিং এ এসে আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে আমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে আবার রওয়ানা হলাম। নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, খৈয়াছড়া ভ্রমণ আমার জীবনের অন্যতম একটি রোমাঞ্চকর ভ্রমন অভিজ্ঞতা।