মেঘের শহর সাজেক

ঘোরাঘুরির তৃষ্ণা আমার বরাবরই। কিন্তু ঢাকার ভিতরের কিছু নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া তেমন কোথাও যাওয়া হয়নি আমার তখনও। কারণ মায়ের তখন কড়া নিষেধ "যেখানেই যাচ্ছ যাও, কিন্তু সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরবে" অগ্যতা আমার ঘোরাঘুরির চিন্তা এক প্রকার বাদ।

তবে হঠাৎ একদিন সকালের সমাবেশে কলেজ প্রিন্সিপল জানালেন কলেজ থেকে ছাত্রছাত্রীদের সাজেক ভ্রমণে নেওয়া হবে। কিন্তু হায় আফসোস বাসায় শোনার সাথে সাথেই মা আমার যেমন মুখমন্ডলের আকৃতি করলেন যেন আমি কোন মানুষকে খুন করার আগে মায়ের অনুমতি চাইতে এসেছি। অতঃপর প্রায় ২ দিন দীর্ঘ অনাহারের পর, এবং চোখের জল নাকের জল এক করে, চোখের নিচে ২ ইঞ্চি কালি ফেলানোর পর অবশেষে মিললো সেই কাঙ্খিত অনুমতিটি। পরের দিনই ৩৭০০ টাকা নিয়ে জমা দিয়ে আসলাম কলেজে।

জীবনে প্রথম আমার দীর্ঘ ভ্রমণ, বলতে গেলে জীবনে প্রথম বাসার বাইরে রাত থাকবো। খুশিতে রোমাঞ্চে আমি পাগল প্রায়। তাড়াতাড়ি গুগল করে জেনে নিলাম ভ্রমণে কি কি সাথে নিতে হয়।সেই ভাবেই ব্যাগ গুছিয়ে বাসার সকলের কাছে বিদায় নিয়ে রওনা দিলাম কলেজের উদ্দেশ্যে। মা বিশেষ কিছু দোয়া-দুরূদ পড়ে মাথায় ফুঁ দিয়ে দিলেন আর বাবা ব্যাগে গুঁজে দিলেন হাজার টাকার ১টা কচকচে নোট। ছোট্ট এক কলেজ পড়ুয়া মেয়ে আমি তখন। আহা এই টাকাই তখন আমার কাছে বিরাট ব্যাপার।

কলেজ গিয়ে দেখি বান্ধবীরা মোটামুটি সবাই উপস্থিত। রাত ৮ টাই আমাদের গাড়ি রওনা দিলো। ১২:৩০ এর দিকে গাড়ি থামলো একটা বড়োসড়ো রেস্ট্রুরেন্টের সামনে ।সেখান থেকে রাতের খাবার সেরে নিয়ে, আবারো গাড়িতে ফিরলে এবার বেশ নাচা-গানা হলো। আনুমানিক ৩-৪ টা পর্যন্ত হৈ হুল্লোড় করার পর সবাই মোটামুটি নেতিয়ে পড়লাম ঘুমের কোলে। সকালে আবারো গাড়ি থামলো একটি রেস্ট্রুরেন্টের সামনে। এবারের রেস্ট্রুরেন্টটি বেশ ভিন্ন। প্রায় ৩০-৪০ ফুট পাহাড়ের উপর রেস্ট্রুরেন্টটি। বেশ উপভোগ করলাম বেপারটা তবে এরই মধ্যে শীত জানান দেওয়া শুরু করলো। সকালের নাস্তা শেষ করতে করতেই দেখি চান্দের গাড়ি নামক এক বিশেষ গাড়ি এসে হাজির।

ভাইরে ভাই পুরো একটা ছোটোখাটো রোলার কোস্টার যেন।বহু উঁচুতে গাড়ি উঠছে মোটামুটি ধীর গতিতেই, আর চূড়ায় উঠেই ভোস করে ছেড়ে দিচ্ছে সে গাড়ি। শীতে নাকি আতঙ্কে আমার শিরদাঁড়া বার বার কেঁপে উঠছিলো তা বোঝার উপায় নেয়। অবশেষে দাঁতে দাঁত চেপে দেড় দুই ঘন্টার যাত্রার পর শেষ হলো রোমাঞ্চ আর উত্তেজনাময় এক যাত্রা। আর আমরা পৌছালাম কাঙ্খিত মেঘের শহর সাজেক ভ্যালি।

মেঘের শহর সাজেক

যেদিকেই তাকাই শুধু সাদা। চারিদিক মেঘ আর কুয়াশায় ছেয়ে গেছে। আর শীত বোধকরি "মঙ্গোলিয়ার" শীতকেও হার মানাবে। এরই মধ্যে কাটার উপর বিষফোঁড়া, না না কাটার উপর এসিড পড়ার মতো শুরু হলো বৃষ্টি।এদিকে আগে থেকে বুকিং দেয়া কর্টেজগুলো খুঁজে পাইনি তখনও। তীব্র শীতে আমরা প্রায় ফ্রিজে রাখা মাংসের পুটলির মতো জমে যাচ্ছি।

অবশেষে কর্টেজ পাওয়ার পর, রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে ওই দিনটি মোটামুটি আশপাশের প্রকৃতি দেখেই কাটিয়ে দিলাম। পাহাড়ের গা ঘেসে উঁচু মাচার উপর তৈরী কর্টেজ গুলো। মেঝের তক্তাগুলোর মধ্যে সামান্য সামান্য ফাঁকা,সেদিকে চোখ যেতেই হীম হয়ে যাই শরীর। বহু নিচে মাটি। কি অদ্ভূত ভয়ানক সে দৃশ্য। মনের অজান্তেই এক অজানা ভয় এসে শরীর নাড়া দিয়ে যাই ।

মেঘের শহর সাজেক

পরদিন খুব ভোরে সবাই ঘুম থেকে উঠে, হায় তুলতে তুলতে এবং শীতে কাঁপতে কাঁপতে, হেলিপ্যাডে গিয়ে উপস্থিত সূর্যোদয় দেখবো বলে। হেলিপ্যাডটি যেনো পৃথিবীতে নয় বরং আকাশের উপরে কোনস্থানে তৈরী কারণ পুরো হেলিপ্যাড ঘিরে চারিদিক শুধু মেঘ আর মেঘ যেন হাত বাড়ালেই তুলোর দলার মতো মেঘ চলে আসবে হাতের মুঠোয়।এক কথায় আমি মুগ্দ্ধ, কি অপূর্ব...কি অপূর্ব ।

মেঘের শহর সাজেক

দুপুরের খাওয়া শেষে রওনা দিলাম সাজেকের মূল আকর্ষনীয় সৌন্দর্য কংলাক পাহাড় জয়ের উদ্দেশ্যে।এটি সাজেক ভ্যালির সর্বোচ্চ চূড়া। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এর উচ্চতা প্রায় ১৮০০ ফুট। আগের দিন বৃষ্টি হওয়ায় পাহাড়ি ঢাল একদম পিচ্ছিল একটু পা ফসকালেই হাজার ফুট খাঁদে গিয়ে পড়তে হবে ফলে কিছু বন্ধুরা ফেরত গেলো কর্টেজে।আর আমরা অল্প কজন দৃঢ় প্রত্যয়ী, ১০ টাকা করে বাঁশের লাঠি কিনে পুনঃরায় রওনা হলাম কংলাক চূড়ার উদ্দশ্যে প্রায় ১ ঘন্টা ভয়ানক,লোমহর্ষক পরিশ্রমের পর আমরা পৌছালাম কংলাকের একদম কাঙ্খিত চূড়ায়। পুরো কংলাক এখন আমাদের পায়ের নিচে, ভাবতেই শিহরিত হলাম। এক নজরে পুরো সাজেকের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় এখান থেকে। সেখানে কিছুক্ষন আমরা আড্ডা দিলাম ও ব্যাগে করে আনা রুচি ঝাল ঝাল চানাচুর খেয়ে শরীরটাকে একটু গরম করে নিয়ে চূড়ায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করতে থাকলাম অপূর্ব সোনালী সূর্যাদয়। রবীন্দ্রনাথ,নজরুল কিংবা জীবনানন্দ যদি বেঁচে থাকতেন তবে সাজেক ও কংলাকের সৌন্দর্য নিয়ে দু-চার লাইন কবিতা তাঁরা অবশ্যই লিখে রেখে যেতেন।

মেঘের শহর সাজেক

সন্ধারপরে আবারো সবাই মিলে হেলিপ্যাডে উপস্থিত। বেশ কিছক্ষন চললো ফানুস উড়ানো ও নানা রকম সাংস্কৃতিক উৎসব।অন্যদিকে আমাদের জন্য তৈরী হচ্ছে বারবিকিউ ও নান রুটি। সাজেকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে তাল মিলিয়ে একটি খাবারের বর্ণনা না দিলেই নয়,সেটি হলো ব্যাম্বো চিকেন। বাঁশের মধ্যে চিকেন ভরে,সেই বাঁশ চুলায় পুড়িয়ে তৈরী হয় এই বিশেষ খাদ্য।বাঁশ আর পোড়া কয়লার এক তীব্র ঘ্রাণ মাংসের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।

মেঘের শহর সাজেক

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সকালের নাস্তা সেরে তৈরী হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে।তবে খাগড়াছড়ি এসে গাড়ি থামল কারণ এখনও কিছু সৌন্দর্যের আধার দেখা বাকি রয়েছে আমাদের। আর সেটি হলো হাজাছড়া ঝর্ণা। মূল রাস্তা থেকে ১৫-২০ মিনিটের হাটা পথ।তবে সমস্যা হলো প্রায় হাটু অবধি কাঁদা জমেছে সে রাস্তায়। অগত্যা জুতো হাতে নিয়ে, সেই কাদা মাড়িয়েই দিলাম রওনা। একজনের ফেলে রাখা পায়ের ছাপের উপর অন্যজন পা ফেলে ফেলে পৌঁছে গেলাম সেই হাজাছড়া ঝর্ণার সামনে। ঝর্ণাটির স্থানীয় পাহাড়িদের দেয়া নাম হল "চিত জুরানি থাংঝাং ঝর্ণা"। যার অর্থ "মন প্রশান্তি ঝর্ণা"।সত্যিই তাই, ঝর্ণার শীতল পানিতে পা ভেজাতেই , এক নিমেষেই যেন সব ক্লান্তি গায়েব হয়ে ,ঝর্ণার পানির সাথেই মিশে গেলো। একই সাথে এর শীতল রূপ ভুলিয়ে দিলো, ফেরার জন্য আবারো কতটা পথ পাড়ি দিতে হবে আমাদের। তবে সেখান থেকে আমরা তাড়াতাড়িই ফেরত আসলাম কারণ তখনোও যে আমাদের আরো একটি কাঙ্খিত জায়গা দেখা বাকি রয়েগেছে ।

মেঘের শহর সাজেক

গাড়ি থেকে নামলাম আলুটিলা গুহার ঠিক সামনে। স্থানীয়রা একে বলে মাতাই হাকড় বা দেবতার গুহা।এই গুহাটির ভেতরে ভয়ানক অন্ধকার ও শীতল। কোন প্রকার সূর্যের আলো প্রবেশ করে না ফলে টর্চের আলো বা মশালই একমাত্র ভরসা । আমরা মশাল নিয়েই প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিলাম। এতে বেশ আদিম আদিম একটা অনুভব আসবে। ১০ টাকার বিনিময়ে এক একটি মশাল হাতে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম, সাথে সাথে সত্যিই মনে হলো যেন প্রাচীন যুগে এসে পড়েছি। দেয়ালের গায়ে প্রাচীন কালের নিদর্শনের ছোয়া,পিচ্ছিল এবং পাথুরে পথ আর একইসাথে পায়ের নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঝর্ণার প্রবহমান শীতল পানি। সামনে কি আছে এখনো জানিনা। এযেন এক অজানা রোমাঞ্চ হাতছানি দিচ্ছে।

মেঘের শহর সাজেক

এডভেঞ্চার প্রেমীদের কাছে যেন প্রতি পদে পদেই এডভেঞ্চার দিয়ে ভর্তি, অপরূপ এই ভূমি সাজেক।আমাদের এ সফর শীত কালে হলেও, অজানা কারণে শীতের মধ্যে বৃষ্টি হওয়ায় একইসাথে শীত ও বর্ষার দুই সৌন্দর্য উপভোগ করতে পেরেছিলাম আমরা।

এর পর সময় পেরিয়েছে খুব। ছোট্ট আমি এখন বেশ অনেকটাই বড়। একে একে বহু দীর্ঘ ভ্রমণ করেছি তবে প্রথম প্রেমের মতো প্রথম ভ্রমণ অভিজ্ঞতাও আমার কাছে চিরস্মরণীয় ও অমূল্যহীন। চক্ষে আমার এখনো তৃষ্ণা। সময় পেলে আমি বার বার ফিরে যেতে চাই অপূর্ব মেঘের শহর সাজেকের বুকে।

মেঘের শহর সাজেক