নিঝুম দ্বীপ আর নিঃস্তব্ধতার গল্প

২০২০ সালের ২২ নভেম্বর হওয়া পরিকল্পনা ৬ থেকে ৭ বার পরিবর্তন হয়ে ডিসেম্বরের ২০ তারিখে বাস্তবায়ন হয় অবশেষে। এই বারবার তারিখ পরিবর্তনের পিছনে যৌক্তিক আর অযৌক্তিক কারণ যেটাই থাকুক না কেন, ২০ ডিসেম্বর আমাদের ৭ জন এর মধ্যে একটা অনুভূতি ই কাজ করছিলো, "যাক, অবশেষে যাওয়া হচ্ছে।" পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের ঢাকা সদরঘাট থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার কথা। দেখা যাক পরিকল্পনার সাথে বাস্তবে ঘটা ঘটনার কতটা মিল বা অমিল পাওয়া যায়, ২০ ডিসেম্বর আমরা এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশ কৌতূহলী ই ছিলাম।

নিঝুম দ্বীপ নোয়াখালী জেলার অন্তর্ভুক্ত হাতিয়া উপজেলায় অবস্থিত একটি দ্বীপ। এক সময় এটি চর ওসমান, বাল্লারচর সহ অন্যান্য নামে পরিচিত থাকলেও ১৯৭৫ সালে বিচ্ছিন্নতা ও প্রকৃতির অনন্য নিঃস্তব্ধতা ও সৌন্দর্যের জন্য একে নিঝুম দ্বীপ নামে নামকরণ করা হয়।

লঞ্চের কেবিন, গঠনমূলক আলোচনার শুরু এখানেই

লঞ্চের কেবিন, গঠনমূলক আলোচনার শুরু এখানেই

বিকালের মধ্যেই সবাই যার যার জায়গা থেকে সদরঘাট চলে আসি। ৭ জন এর জন্য ৫ টা ডেকের টিকেট আর একটা ডাবল কেবিন নিয়ে নেই। লঞ্চ ছাড়ার আগে রাতের খাবার কিনে নিয়ে লঞ্চে উঠে পড়ি। মাগরিবের একটু আগে যখন লঞ্চ হাতিয়ার উদ্দেশ্য সদরঘাট ছেড়ে যায়, তখনও আমরা বুঝতে পারিনি যে পরবর্তী দিনে মনে রাখার মতো বেশ কিছু মুহূর্ত তৈরি হতে যাচ্ছে। কেবিনে বসে গল্প-আড্ডা চলতে থাকলো, সাথে পুরো রাতটাতে কি কি করা যেতে পারে তা নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা।

লঞ্চে আমরা একবার এদিক থেকে ওদিকে যাই, ঝালমুড়ি কিনি, চা নিয়ে ঘুরে বেড়াই। এইসব করতে করতে ঘুমানোর যৌক্তিকতা আর খুজে পেলাম না। ফজরের একটু আগে লঞ্চ মনপুরা এসে দাড়ালো বেশ কিছুটা সময় এর জন্য, আমরা লঞ্চ এর ছাদে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি ভয়াবহ হিমশীতল বাতাস, বেশিক্ষণ থাকার মতো অবস্থা কোনভাবেই নেই।

হাতিয়ার তজুমুদ্দি ঘাটে এসে যখন পৌছাই, তখন বেলা ৭ টা বেজে গেছে। ঘাটের পাশের হোটেল থেকে সকালের নাস্তা সেরে নিয়ে একটা বোরাক আরেকটা মোটরসাইকেল ঠিক করে ফেলি, গন্তব্য মোক্তারিয়া ঘাট। মোটরসাইকেল এ আমরা দুইজন শীতের মাত্রা টা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছিলাম। মাঝপথে একটা চায়ের দোকানে থেমে চা খেয়ে নেই। ক্ষণিকের জন্য শীত এর হাত থেকে রক্ষা পেতে এর চেয়ে ভালো কিছু বোধহয় আর হতো না তখন।

দীর্ঘ হিমশীতল যাত্রা শেষে অবশেষে মোক্তারিয়া ঘাটে এসে পৌছালাম। সেখান থেকে ইঞ্জিনের নৌকায় করে ছোট একটি চ্যানেল পার হয়ে প্রস্তুত হলাম শেষ মোটরসাইকেল যাত্রার জন্য। এবারের যাত্রা টা অল্প দূরত্বের আর ততক্ষণে সূর্যের প্রখরতা বেশ ভালোই টের পাওয়া যাচ্ছে।

অবশেষে নামার বাজার এসে পৌছালাম। এবার ডিসিশন নেওয়ার পালা। রাতে কি করবো, কোথায় থাকবো। সারারাত বিস্তীর্ণ আকাশের তারা দেখতে দেখতে তাবুতে রাতটা কাটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা টাই ছিলো সবার মনে। সেই অনুযায়ী তাবু ঠিক করে ফেলা আর দুপুরের জন্য প্যাকেজ সিস্টেমে খাবারের কথা পাকাপাকি করে ফেলা।

বিস্তীর্ণ নিঝুম দ্বীপ সী বীচ আর আমাদের তাবু

বিস্তীর্ণ নিঝুম দ্বীপ সী বীচ আর আমাদের তাবু

বেলা তখন ১২ টার বেশি বেজে গেছে। সূর্যের তাপে শীতের ভাব পুরোটাই যায় যায় অবস্থা। এর মধ্যেই নিঝুম দ্বীপ এ আমাদের তাবু খাটানো শেষ, কিন্তু দুপুরের খাবারের আগে কি করা যায়? পাশেই বিস্তীর্ণ নিঝুম দ্বীপ সী বীচ। ঠিক করলাম এই সময় টা সী বীচ এই ঘুরাঘুরি করে কাটিয়ে দেওয়া যাক। নিঝুম দ্বীপ সী বীচ বাংলাদেশের অন্যান্য সী বীচ গুলো থেকে তুলনামূলক বেশি পরিষ্কার। সাদার মধ্যে একঝাঁক লাল কাকড়া এক মোহনীয় সৌন্দর্যের হাতছানি দিচ্ছিলো। তবে রৌদ্রের তাপ ও ছিলো প্রখর। আমরা দুপুরের খাবারের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম।

দুপুরের খাবার শেষে পরিকল্পনা অনুযায়ী সাইকেল ভাড়া করে নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যান আর দ্বীপের আশপাশ ঘুরে দেখার পালা। কিন্তু বিপত্তি সাধলো আমাদের সংখ্যা টা। পুরা নামার বাজার খুজে ও ৭ জন এর জন্য সাইকেল ম্যানেজ করা গেলো না। কি আর করা। সবাই মিলে ঠিক করলাম বিকাল বেলা টা সী বীচ এই কাটাবো, সাথে সূর্যাস্ত। জাতীয় উদ্যান ঘুরার পরিকল্পনা পরেরদিন সকালের জন্য থাকলো।

নিঝুম দ্বীপ!

নিঝুম দ্বীপ!

তাবু থেকে আমরা সী বীচ এর দিকে হাটা শুরু করি, উদ্দেশ্যহীন যাত্রা, যতটুকু যাওয়া যায়। চারপাশে মৃদুমন্দ বাতাস, লাল কাঁকড়ার ঝাক, নির্জন সমুদ্র সৈকত। বিকালটাকে জীবনে মনে রাখার মতো অন্যতম একটি মুহূর্ত বললে এতটুকু ও ভুল হবার কথা না। একসাথে পাশাপাশি দাঁডিয়ে ছিলো কয়েকটা গাছ কিন্তু আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো অন্য একটি গাছ। নির্জনভাবে একা দাড়িয়ে ছিলো, যেন নিঝুম দ্বীপ এর নামকরণ এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থিতি জানাচ্ছে নিজের। এরপর আসলো সেই স্বর্গীয় সময়, সূর্যাস্ত। আমি নিজের মধ্যে অন্য রকমের এক শূন্যতা অনুভব করছিলাম, সম্ভবত নির্জন দ্বীপের আশ্চর্য মোহনীয় এক ক্ষমতা।

সূর্যাস্ত আর তার অপরূপ আভা

সূর্যাস্ত আর তার অপরূপ আভা

সন্ধ্যার পরপরই চলে আসলাম নামার বাজারে। অন্ধকার বাড়ার সাথে সাথেই নামার বাজার নিজেকে সজ্জিত করে ফেলে লোকজন, স্থানীয় খাবারে। আমরা লুচি, ডাল দিয়ে সন্ধ্যার খাবার সেরে নিতেই দেখা পেলাম কিছু কুকুর এর যারা নিজেদের ভাগের খাবারটুকু না নিয়ে পিছু ছাড়তে নারাজ। অপরিচিত লোক দেখলেই চিনতে পারার ক্ষমতাটা আছে তাদের বেশ ভালো ভাবেই।

রাতের খাবার শেষে এবার পালা তাবুর নিচে বসে তারকাসমৃদ্ধ দিগন্তব্যাপী আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার। নির্জন দ্বীপ, চারিপাশে তাবুর রকমারি আলো, সীমাহীন আকাশের নিচে আমরা একা। এই মহাবিশ্বের কাছে নিজের ক্ষুদ্রতা, তুচ্ছতা উপলব্ধি করার এর চেয়ে ভালো সময় বুঝি আর হয় না। আশেপাশে থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসছিলো শিয়াল এর ডাক। কিছুটা গা ছমছমে এক মোহনীয় পরিবেশ, যা হয়তো শুধু এই নির্জন দ্বীপ এই সম্ভব।

“The stars are mansions built by Nature’s hand,
And, haply, there the spirits of the blest
Dwell, clothed in radiance, their immortal vest.
Huge Ocean shows, within his yellow strand,
A habitation marvellously planned,
For life to occupy in love and rest” - William Wordsworth

নিঝুম দ্বীপের সকাল

নিঝুম দ্বীপের সকাল

নিঝুম দ্বীপ এর সকালটা সুন্দর ছিলো। অনেকটা ছোটবেলায় পড়া "উইন্টার মর্নিং" প্যারাগ্রাফ এর মতো। তবে বেশ কিছু নতুনত্ব ও ছিলো। আমাদের তাবুর পাশ দিয়েই গরু-মহিষের পাল চলে যাচ্ছিলো, সাথে ছোট্ট বাচ্চারা। বিশালাকৃতির গরু-মহিষের ক্ষুদে মালিক যেন নির্জনতার পদচিহ্ন ফেলে যাচ্ছে নিঝুম দ্বীপে।

এবার নামার বাজারে যেয়ে সকালের নাস্তা করে নেওয়ার পালা। আর নাস্তা শেষেই গতদিনের অপূর্ণ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করার পালা। আমরা বের হলাম নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যান এর উদ্দেশ্যে। উদ্যানের শুরুতেই একটা ওয়াচ টাওয়ার, যেখান থেকে নিঝুম দ্বীপ মোটামুটি পুরোটাই দেখা যায়। দুর্ভাগ্যবশত আমরা হরিণের দেখা পেলাম না, তবে নিপুণ নান্দনিকভাবে কিছু লোকজন কে জাহাজ তৈরি করতে দেখলাম। এই জাহাজ গুলো নিয়েই তারা ভেসে বেড়াবে মেঘনার দিগন্তব্যাপী জলরাশিতে। সূর্য তখন পুরোপুরিভাবে জানান দিচ্ছে নিজের উপস্থিতির, আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি বিদায়ের।

নিঝুম দ্বীপ এর বুকে শুধুমাত্র নিজেদের পদচিহ্ন রেখে আর মনে রাখার মতো অসংখ্য মুহূর্ত নিয়ে আমরা চলি পরবর্তী গন্তব্যে। এমন সব মুহূর্ত, যা অনেক অনেক দিন পরে হয়তোবা কোন এক নির্জন বিকেলে মনে পড়বে আর মনের অজান্তেই মুখে হাসি ফুটাবে।

“We travel, some of us forever, to seek other places, other lives, other souls.” – Anais Nin