উত্তরা গণভবন এক টুকরো মেঘের নিচে স্বর্গরাজ্য

‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।’

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ নাটোরের রূপ-সৌন্দর্যকে এমনভাবে কবিতার লাইনে তুলে এনেছেন, যেন সবাই ‘বনলতা সেন’কে আজও খুঁজে ফেরে। বনলতাকে সেনকে খুঁজতে হলে দেখতে হবে নাটোরের রূপ-সৌন্দর্যের উৎসমূল্য কোথায়? কোথায় এমন সৌন্দর্য লুকায়িত যা কিনা ক্লান্ত ভ্রমণপিয়াসুদেরকে দুদÐ শান্তি দিবে।

হ্যাঁ, আমাদেরকেও দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল কাঁচাগোল্লাখ্যাত নাটোরের ‘উত্তরা গণভবন’। একবার এক ব্যক্তিকে জিগ্যেস করা হয়েছিল, ‘উত্তরা গণভবন কোথায় অবস্থিত?’ তিনি বলেছিলেন, ‘কোথায় আবার হবে, উত্তরায় (ঢাকা)!’ হাসতে হাসতে পেটে খিল লাগার উপক্রম। না হাসালেও ‘উত্তরা গণভবন’ ভ্রমণপিয়াসুদের মনে প্রবল প্রশান্তির খোরাক যুগিয়ে থাকে। সম্প্রতি নাটোর মূল শহর থেকে ২.৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ‘উত্তরা গণভবন’ ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমাদেরও। যতটা সময়জুড়ে ভেতরটায় ঘুরে বেড়ানো হয়েছিল, তা নিতান্ত কমই ছিল।

উত্তরা গণভবন

‘উত্তরা গণভবন’ এককালের দিঘাপাতিয়া মহারাজাদের বাসস্থান ছিল এবং বর্তমানে এটি উত্তরাঞ্চলের ‘গভর্মেন্ট হাউস’। ইতিহাস থেকে জানা যায়, গণভবনের প্রাসাদের মূল অংশ এবং সংলগ্ন কিছু ভবন নির্মাণ করেছিলেন রাজা দয়ারাম রায়। রাজবংশের ষষ্ঠ রাজা প্রমদা নাথ রায়ের আমলে ১৮৯৭ সালের ১০ই জুন নাটোরের ডোমপাড়া মাঠে তিনদিনব্যাপী বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের এক অধিবেশন আয়োজন করেছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি এ অধিবেশনে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন। অধিবেশনের শেষদিন ১২ই জুন প্রায় আঠারো মিনিটব্যাপী এক প্রলয়ংকরি ভ‚মিকম্পে রাজপ্রাসাদটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। পরে রাজা প্রমদা নাথ রায় ১৮৯৭ সাল থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত এগারো বছর সময় ধরে বিদেশী বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী, চিত্রকর্ম ও দেশী মিস্ত্রিদের সহযোগিতায় সাড়ে ৪১ একর জমির ওপর রাজবাড়িটি পুনঃনির্মাণ করেন।

নাটোর শহর থেকে অটোরিক্সাযোগে পৌঁছে সুবিশাল গেটের সামনে দাঁড়াতেই আমাদের চোখে পড়ে বিস্তৃত প্রাসাদের উচু প্রাচীর ও সারি-সারি বোতল-পামের বৃক্ষ যা দেখে নিমিষেই চোখ জুড়িয়ে যায়। প্রাসাদের পূর্বপাশে পিরামিড আকৃতির চারতলা প্রবেশদ্বার আছে যা উপরের দিকে সরু হয়ে গেছে এবং এর উপরে একটি ঘড়ি আছে। ঘড়িটি আমাদেরকে মুহূর্তের ভেতর অবাক করে তোলে। স্থানীয় একজনকে ঘড়িটি সর্ম্পকে জিগ্যেস করি। তিনি বলেন, ‘স্যার, এইযে ঢুকতেই বিরাট ফটক দ্যাখছেন না, এইডা কইল বিরাট ঘড়ি। ঘড়িখান রাজা দয়ারাম সেই-ই-ই সময় ইংল্যান্ড থেইক্যা আনছিলেন। ঘড়িডার পাশে আছে একটি বিরাট ঘণ্টা। একসময় এই ঘণ্টাধ্বনি মেলা দূর থেইক্যা শোনা যাইতো। শহরের তামাম কিছু এই ঘড়ির সময়ে হইতো।’

কনকনে শীতে শহর থেকে ছুটে আসা পরিযায়ী পাখির মত দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে উত্তরা গণভবনের মূল ফটক দেখতে থাকি। একটুকরো মেঘের নিচে স্বর্গরাজ্য। তারপর প্রবেশদ্বারের পাশে কাউন্টার থেকে জনপ্রতি বিশ টাকা মূল্যের দর্শন-টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করি। ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে, মধ্যযুগীয় বাংলাদেশের অন্যান্য সামন্ত প্রাসাদের মতই নাটোরের রাজবাড়িতে প্রবেশের দীর্ঘপথ। কী মনোমুগ্ধকর দৃশ্য! প্রবেশ পথ ধরে সন্তঃপর্ণে হাঁটতে থাকি দলবেঁধে। সৌন্দর্য এমনভাবে আমাদেরকে ঘিরে ধরে, কোথায় চোখ রাখব- ঠিক বুঝে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে। চোখ মেলতেই দেখা মেলে প্রাসাদের ভেতর বহু প্রাচীন ও দুর্লভ প্রজাতির গাছের সমারোহ। এখানে এসে জানতে পারি, ঢাকার জাতীয় স্মৃতিসৌধের শোভাবর্ধনকারী রোপণকৃত ফুল ব্রাউনিয়া ও ককেসিয়া এখানকারই। গাছগুলো ছুঁয়ে ধরতেই কেমন যেন ভালোলাগা ভেতর থেকে কাজ করতে থাকে। গাছের গায়ে নাম-ফলকের লেখা পড়ে জানতে পারলাম- এখানে আছে রাজ-অশোক, সৌরভী, পরিজাত, হাপাবমালি, কর্পূর, হরীতকী, যষ্টিমধু, মাধবী, তারাঝরা, মাইকাস, নীলমণিলতা, হৈমন্তীসহ বিভিন্ন দুর্লভ প্রজাতির ফলজ ও ঔষধি বৃক্ষ। প্রাসাদের মধ্যে লেকের পাড়ে এসব বৃক্ষাদির মহাসমারোহ আমাদেরকে প্রতিক্ষণে মুগ্ধ করেছিল।

শীতের সোনালী রোদের পরশ গায়ে মেখে গণভবনের ভেতরটায় ঘুরতে থাকি। প্রাসাদের প্রবেশ পথের চারিদিকে প্রাসাদঘেরা পরিখা যা পুরো রাজপ্রাসাদকে ঘিরে রেখেছে। এত বড় পরিখা দেখে অবাক না হয়ে আর পারি না। ভেতরে বিশাল মাঠ ও গোলাপ-বাগান, একপাশে গণপূর্ত অফিস। দ্বিতল হলুদ ভবনটি ‘কুমার প্যালেস’ নামে পরিচিত। নিচতলাটি টর্চারসেল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। একটি একতলা তহশিল অফিস আছে। সে সময়কার চারটি কামান পরিলক্ষিত হয়। কামানগুলোর স্থাপনকাল ১৭৯৯ সাল। বিশাল রাজদরবার সংলগ্ন বাগানে জমিদার দয়ারামের একটি ভাস্কর্য তাঁর স্মৃতিচারণের প্রতীক। প্রাসাদের মধ্যে একটি মিলনায়তন ভবনসহ আছে আরও দুটি ভবন। গাড়ি পার্ক করার আছে আলাদা গ্যারেজ। যাবতীয় স্থাপনা মাঝখানে। প্রাসাদের ভেতর রয়েছে বিভিন্ন ব্যবহার্য জিনিসপত্র। ভবনের মধ্যে জাদুঘর, বহু দর্শনীয় স্মৃতিস্তম্ভ, ভাস্কর্য ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য বিদ্যমান। এসব নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘উত্তরা গণভবন সংগ্রহশালা’।

জানতে পারি, ইতালিয়ান গার্ডেন ‘উত্তরা গণভবন’র সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য অংশ। গার্ডেনটির আসবাবপত্র রাজা দয়ারাম ইটালি থেকে আনিয়েছিলেন। ভাঙা জানালা-দরজার ফাঁকফোকর দিয়ে দেখতে বেশ ভালো লাগে আমাদের। রোদ পড়ে জ¦লজ¦ল করছিল কক্ষ। পাশেই ছিপ হাতে কালো রঙের মার্বেল পাথরের মূর্তিটি উপভোগ্য ছিল। বেঞ্জগুলো কলকাতা থেকে আনানো হয়েছিল। পাহাড়ি-কন্যা পাথরের মূর্তিটির এক হাত ভাঙা। কিন্তু কেন? সে উত্তর পাইনি আমরা। তবে হাতের কব্জিটি স্বর্ণ দিয়ে বাঁধাই করা ছিল। এখানে রাণীর ‘টি হাউস’টি অতুলনীয়। রাণীর জন্য কতো মনোরম কক্ষ ছিল, তাই না? আমরা ফিসফাস করে বলতে থাকি।

‘উত্তরা গণভবন’ চত্বরে হাঁটতে হাঁটতে গুণে ফেললাম- এখানে মোট ছয়টি পুকুর আছে। সেগুলো হল- গোলপুকুর, পদ্মপুকুর, শ্যামসাগর, কাছারিপুকুর, কালীপুকুর ও কেষ্টজির পুকুর। এছাড়া গণভবনের ভেতরের চারপাশে সুপ্রশস্ত পরিখা রয়েছে। প্রতিটি পুকুর পরিখায় সানবাঁধানো একাধিক ঘাট আছে। মন বলছিল, ঘাটে বসে সবুজাভ পানি ছুঁয়ে দেখি। দুঃখের বিষয়, দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় পুকুরগুলো ভরাট হয়ে গিয়েছে। ঘাট ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। আরেকটি দুঃখের বিষয়- প্রাচীন এই অবকাঠামোকে ঘিরে অজস্র আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, মেহগনি, পাম ও চন্দনাসহ দুর্লভ জাতের গাছ লাগানো ছিল। অযতœ আর অবহেলায় ইতোমধ্যে অনেক গাছ বিলুপ্ত হয়েছে। গাছ কেটে ফেলা নিয়ে কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছারিতার খবরও পড়েছিলাম কিছু দিন আগে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, তারও ছাপ মিললো।

আমরা যতটা সময় ধরে গণভবনের সবুজ ঘাসের ওপর হাঁটতে থাকি, তত যেন জানতে থাকি ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায় সম্পর্কে। ফলক পড়ে জানতে পারি, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর দিঘাপতিয়ার শেষ রাজা প্রতিভা নাথ রায় দেশ ত্যাগ করে চলে যান। এসময় থেকে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকে। ১৯৬৫ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার রাজবাড়িটি অধিগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালের ২৪ জুলাই তৎকালীন গভর্নর হাউসে রূপান্তরিত হয়। স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এটিকে ‘উত্তরা গণভবন’ হিসেবে ঘোষণা দেন। তিনি ১৯৭২ সালের ৯ই ফেব্রæয়ারি মূল প্রাসাদের ভেতর মন্ত্রিসভার বৈঠক আহবান করেন। সেই থেকে ‘উত্তরা গণভবন’ তার প্রকৃত মর্যাদা লাভ করে।

হাঁটতে হাঁটতে একসময় প্রাসাদের পেছন-দিকে পৌঁছে যাই আমরা। সেখানে রয়েছে ফোয়ারাসহ একটি সুদৃশ্য বাগান। বাগানের এককোণে রয়েছে প্রমাণ আকৃতির মার্বেল পাথরের তৈরি একটি নারী-মূর্তি। আগে নাকি এই ফোয়ারায় কাউকে প্রবেশ করতে দিতো না। বর্তমানে এখানকার সব স্থানই দর্শক-পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত। এখানে বিভিন্ন নাটক-সিনেমার শুটিংও হয় নিয়মিত। ১৯৪৭ সালের পর এ রাজবাড়িতে কেউ বসবাস না করলেও বর্তমানে প্রতিদিন দর্শনার্র্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে রাজবাড়ির সবুজ-শ্যামল প্রাঙ্গন। বিশেষ ব্যবস্থায় জেলাপ্রশাসকের কার্যালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে উন্মুক্ত রয়েছে। কয়েক ঘণ্টা পুরো রাজবাড়ি ঘুরে দেখার পর আমার অনুভ‚তি ফুটে উঠেছিল স্বরচিত তাৎক্ষণিক কবিতার চরণে-

‘কী অপরূপ! পাখির চোখে উত্তরা গণভবন,
তুমি নারী হলে, পাগল হত আমার কবিমন।’

উত্তরা গণভবন

যাওয়ার উপায়:

ঢাকা হতে কমলাপুর/বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে উত্তরবঙ্গগামী যেকোনো ট্রেনে উঠলে পাঁচ-ছয় ঘণ্টার মধ্যে নাটোর রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছে অটোরিক্সাযোগে যাওয়া যায়। বাসের ক্ষেত্রে আন্তজেলা বাস কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে নাটোরগামী বাসে উঠে খুব অল্প সময়ে পৌঁছে নাটোর বাইপাস থেকে অটোরিক্সাযোগে যাওয়া যায়। উভয়ক্ষেত্রে অটোরিক্সায় ভাড়া লাগবে ১৫-২০ টাকা মাত্র।