
- salman09918623
- On 17 Jun, 2020 8:04 AM
একটি কাব্যিক যাত্রার আখ্যান
তখন অনন্ত ঘুমের তরে গল্পের রঙ ঝিলমিল
সালমান সাদ
আমি লঞ্চডুবিতে মারা যাবো।
খুব মৃত্যুভাবনা হয়। আমি হয়ত আজকাল যেকোনো সময় টুপ করে খুব নীরব কোন এক দুপুরে মিলিয়ে যাব ভোরের শিশির লাগা মাকড়সার জাল যেমন মিলিয়ে যায় হাওয়ায়।
ভয়ের কথা, মৃত্যুর আগেই নাকি মানুষের মনে হতে থাকে যে সে মারা যাবে মারা যাবে…
লঞ্চে আমাকে উঠতেই হবে, ফিরতে হলে আমাকে জলের স্মরণ নিতেই যে হবে, আমি সাঁতার না জানা শহুরে, আরো শঙ্কার কথা, আমার অবচেতনে প্রায়ই গুঞ্জরিত হয়, আমি লঞ্চডুবিতে মারা যাব।
দ্বিতীয় তলার ডেক পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে,আমি কোথায় বের হব কোথায় পালাব এই অফুরন্ত জলের রাজ্যে , পানির প্রকাণ্ড চাপ আমাকে গিলে নিচ্ছে, শ্যাওলাগন্ধী নিবিড় অন্ধকার আমি প্রায়ই স্বপ্ন দেখি।
আমার ভাবনা শুনে মিলু ভাই অট্ট হাসলেন ও অন্যদের হাসালেন। মিজু ভাই কপট ফিসফাস করে বলে গোপন কথার ভঙ্গিতে, নদী কিন্তু সবার কথা কান পেতে শোনে। কোন কথা যদি হঠাত সে কবুল করে ফেলে!
কুয়াকাটা এসে বন্ধু জুটে গেছে কয়েকজন। মিলুদা এদের মধ্যে রীতিমতো গুরু বনেছেন – আমরা, বাচ্চা বাচ্চা তরুণপালের বড়ভাই বনে যেতে তার অন্য সবার তুলনায় তার ভার-ভারিক্কি চেহারা, আর গলার স্বরের প্রাপ্তবয়স্কতা, তবুও বড়াই বড়ত্বের সবকিছুই তার ভেতর বহাল তবিয়তে – বর্তমান ;
বললেন, এই ভরা শীতের মৌসুমে, নদী যখন ক্ষীরের মত জমে যাচ্ছে কমে যাচ্ছে, দুইপারে পানির স্তর বাঁধের দেয়ালের শেষ ইট ছাড়িয়েও ক্রমেই নীচে নামছে নীচে নামছে, লঞ্চ যখন প্রায়ই চরে আটকাচ্ছে জলের অভাবে, এই সময়ে তুই কিনা মরবি জলে ডুবে!
অন্যেরাও তাল ধরে সায় দেয়, এই মৌসুমে লঞ্চ কি, কোন কোষা নৌকাও ডুবতে কখনো শোনেনি তারা কেউ।
আকাশ কুসুম বাজে কল্পনা, দুচ্ছাই, বিরক্ত মাহি গিটারে টুংটাং শুরু করতেই অন্য একটা পরিবেশ রঙ চড়িয়ে ফেললো আমাদের আয়েসি মজমায়, কুয়াকাটার সমুদ্রতীরে, এই হেমন্তের মায়াবী সন্ধ্যায়।
এই এখন, কবিতার পেছনে ছোটার তুমুল ব্যস্ততা, নদীর সঙ্গে, পানার নীলাভ সাদা ফুলের সঙ্গে, নির্জন তীরে বাঁধা পুরনো নৌকার সঙ্গে, ধানশালিক – দোয়েলের সাদাকালো হলুদ রঙের সঙ্গে , যখন তখন বেরিয়ে পড়ার মধ্যে মৃত্যু নিয়ে মন খারাপ অভিমানের ফুরসত কোথায়!
অদ্ভুত এক নির্লিপ্ততা, গরুর চোখের মত অবুঝ সরল চাহনিতে জীবন চেয়ে আছে আমার দিকে।
২.
ঘুম যখন ভাঙলো, দেখি মাথার ওপর কারুকাজ করা সিলিং, এসি সুড়সুড় করে হাওয়া দিচ্ছে, আমার গায়ে দারুণ ওম ভরা একটি কম্বল, মাথার নীচে বালিশ নয় ওটা, যেন একদলা তুলার মাখন, নীলচে একটা আলো-আঁধারি, জানালা দিয়ে জোসনা ঢুকে ফুলঝুরি সাজিয়েছে মেঝেতে।
কোথায় এলাম আমি! কুয়াকাটায় আমরা ক্যাম্পেইন করেছিলাম, সাদামাটা এক তাঁবু থেকে আমি এ কোথায় এলাম, কীভাবে এলাম,কী আশ্চর্য, স্বপ্ন নাকি ভোজবাজি! দেয়ালে কান পেতে শুনতে পেলাম কেমন একটা গমগম শব্দ হচ্ছে, ততক্ষণে ঘুমের ঘোর কেটে সজাগ হলাম, উঠে বসলাম, দেখি পাশের খাটে মিলুদা জাগ্রত, শুয়ে আছে, ডানের ওপর বাঁ পা-টা তোলা , স্মার্টফোনের ঝাপ্সা আলোয় মুখ আবছা।
জানালা দিয়ে দেখি মরা নদীর পানি ঝিকমিক করছে পূর্ণ চাঁদের আলোয়, এটা কোন জলযান , জলরাশি কেটে ছুটছে।
মনে পড়লো, ফেরার দিন আমি চেয়েছিলাম ঘুরপথে সড়কপথে ঢাকা ফিরবো। হাত কচলে মাথা চুলকে আমতাআমতা বলেছিলাম,
আমি আজ ঢাকা যাবোনা । কেন রে? ভয় করছে।
প্রস্তাব শুনতেই সবাই হইহই করে উঠল, একসাথে এসেছি, ট্যুর করেছি, একসাথেই সবাই আনন্দ করতে করতে ফিরবো, মাঝখানে একজন আলাদা হলে উল্লাসের রেশ শেষ হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাবে, তাও নিতান্তই অবান্তর এক ভাবনার কারণে, অসম্ভব!
এমন সময় যেই ঘটনাটি ঘটলো, মাহদি হাসতে হাসতে, আমার ব্যাগপত্র হেঁচকা টানে তুলে নিলো ওর কাঁধে, ওদের সাথে লঞ্চযাত্রা নিশ্চিত করতে, আমার কী হলো, দেখি ও মাটিতে বসে কোঁকাচ্ছে, ভূতগ্রস্তের মতো ঠাস করে কখন একটা চড় বসিয়ে দিয়েছি জানিনা, ঘাটে আশপাশে লোকেরা এসে আমাকে ধরলো, বন্ধুরা সবাই মাহদির দিকে ছুটে গেলো আমার দিকে অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে,
কী বিব্রতকর পরিস্থিতি, লজ্জায় ঘেমে যাচ্ছি, সবাই কেমন দূরে সরে আছে, আড়চোখে তাকাচ্ছে কি তাকাচ্ছেনা, নিজেকে কেমন নিঃস্ব, ভরপুর লোকারণ্যেও কেমন নিঃসঙ্গ লাগছিল ।
ভাগ্যিস কি খোদার কুদরত, সুবন্ত ভাই তাঁর দারুণ নেতৃত্বগুণে – আমি চমকে মুগ্ধ হয়েছিলাম সেদিন – পুরো পরিস্থিতি আগের মত স্বাভাবিক করে ফেলার ক্ষমতা দক্ষতায়।
সেদিনের মত আমাদের যাত্রা স্থগিত হলো, কুয়াকাটা ভ্রমণে আরেকটি সুন্দর, এমনকি অন্যসব দিনের চেয়েও মনে হয় উপভোগ্য একটি দিন যুক্ত হলো।
একসাথে কেবিন নিয়েছি, ভাবলাম, তোকে নিয়ে সাঁতরাবো নদীতে, কই তোর লঞ্চ তো ডুবলো না, ঢাকা সদরঘাট এসে গেলো প্রায়, দেখ বুড়িগঙ্গার দ্বিতীয় সেতু পার হচ্ছি আমরা।
আমি এখানে এলাম কীভাবে?! কখন কী ঘটল?
সুবন্ত’দা খাট থেকে নেমে জুতোজোড়া পায়ে দিতে দিতে বললেন, আসতি তো না। নিয়ে আসতে হলো। রাতে খোলা সমুদ্রের প্রান্তরেখায় বারবিকিউ পার্টির পর সেই যে ঘুমালি, আসলে জানিস কি, আমি তো ফার্মাসিস্ট, কিছু তুকতাক আর শেকড়বাকড়ের রস সবসময় সাথে থাকে আমার প্রাথমিক চিকিৎসা-থলিতে , সবাই সে রাতে ঘুমিয়ে গেলে পর একটু ক্লোরেফর্ম তোর নাকের কাছে ডলে দিলাম, সেই এক ডলায় জাগলি এসে ঢাকায়।
আমি বজ্রাহতের মত থ হয়ে রইলাম, কেমন রাগ হতে লাগলো, কিন্তু সেই রাগ কেন কার ওপর তাও আন্দাজ করতে না পেরে অব্যক্ত একটা জিদে কথা সরে না মুখে, সুবন্ত ভাই চোখ টিপ দিয়ে বললেন, আমার গা জ্বলে গেলো যেন,
নে সব গোজগাছ করে ছাদে আয়, দেখবি কী বাতাস, ভাসিয়ে নেবে যেন, সবাই আছে।
এই লোকটার কি মানুষের মানসিক পরিস্থিতি-বিচার করে কথা বলার জ্ঞানটুকুও নেই!
তবুও,
লোহার পেরেকের জং ধরা ধারালো মাথার মতো একটা দুর্ভাবনা মগজে খোঁচা দিচ্ছিল বারবার। হঠাত খুব শান্তি শান্তি লাগতে থাকে। কেমন কৃতজ্ঞ বোধ করি মিলুদার প্রতি, ঘুমে ঘুমে সুস্থির ভাবে ফেরাটা হলো, আমার উদ্ভট পাগলামিটা তারা কী ধৈর্যের সাথে বহন করে দারুণ এক মোলায়েম কৌশলে আমার ভয়কে জয় করালেন।
কিসের মৃত্যু আর কিসের লঞ্চ ডোবা !
কী নির্বোধ প্রশান্ত এক নদী, তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে, রৌদ্রের আলোয় ঝিকমিক করে সুবোধ জল, লঞ্চের সাথে খেলতে খেলতে ঢাকার পথে যাচ্ছে মৃদু মৃদু ঢেউ, একটু দূরেই দুইপাশে দেখা যাচ্ছে তীর, শ্যামল গ্রাম, ধানক্ষেত, ইটভাটা, কলকারখানা, শহর।
ব্যাগপত্র হাতে-কাঁধে গুছিয়ে লঞ্চের ছাদে উঠে আসতেই সবাই বলে উঠলো, কী, মরলে না তো!
আমি দারুণ হেসে উঠলাম, মুখে ঝুলে রইল টুকরো লজ্জা, ছাদে একটি অচেনা মেয়ে ওদের সাথে, আমি আগে দেখিনি, হয়ত লঞ্চেই কোনভাবে কারো সাথে পরিচয় হয়ে এখানে বা নেহাতই অপরিচিত মেয়ে কোন, ছাদে হাওয়া নিচ্ছিল, অতি মায়াবতী, মন্তব্য করে লাজুক বাচ্চাটির মত ঘাড় ফেরালো,
– এত সুন্দর যার হাসি, এই হাসির মায়ায় তো মালাকুল মওতও ভুলে যাবে তাঁর জান কবজের দায়িত্ব!
আমার সবকিছু ভালো লাগছিলো, সবকিছু কত প্রাঞ্জল, জীবনের এত এত সৌন্দর্য! সব না দেখে আমি মরবোনা, নিশ্চিত।
ঘাটের সাথে লঞ্চের মাথাটা আস্তে একটা গোঁত্তা মেরে থেমে গেলো। চূড়ান্তই, শেষ হলো আমাদের কুয়াকাটা ভ্রমণ।
- একটি ঘোরগ্রস্থ যাত্রা, কুয়াকাটায় লঞ্চ ভ্রমণ
- Bangladesh
- Kuakata— Dhaka
- Boat/Launch
- হোটেল মোটেল
- ভাত মাছ মাংস ডিম দুধ শুকনো খাবার