প্রতিযোগীঃ Moshior Rohman

নামহীন দুটি ঝর্ণা এবং একটি গভীর সন্ধ্যা। নিজের জন্য আমি সবসময় পাহাড়কেই বেছে নিই। পাহাড় আমাকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখায়, শেখায় বিনীত হতে। আমি স্থিরতাকে ধারণ করতে শিখি, অপরের জন্য বেঁচে থাকতে শিখি। আজকাল প্রায় সবাই পাহাড়ে যায়, নতুনকে খুঁজতে না, চেনা পরিচিত কিছু খুম আর পাহাড় ঘুরে দেখতে। কিন্তু আমি চাই অজানাকে জানতে, চেনা পৃথিবীর বাইরের জগতটাকে দেখতে। প্রকৃতির মাঝে নিজের নতুন আশ্রয় খুঁজে নিতে। তাই আমাদের আজ কোনো গন্তব্য নেই। নতুন কিছুকে পাবো বলেই গন্তব্যহীনতায় চলতে থাকি। আলীকদমের খুব কাছে থেকেই একটা ঝিরিপথ ধরে হাঁটতে থাকি। ঝিরি বা Stream হচ্ছে অগভীর পানির প্রবাহ। সাধারণত এই পথগুলো বেশ সরু আর অরণ্য আচ্ছাদিত হয়। ঘন অরণ্যের মাঝখানে ছোট বড় আর নুড়ি পাথরের উপর এঁকেবেঁকে চলে স্রোত ধারা। গাছের ফাঁকের ভেতর দিয়ে সুর্য। রোদের আলোয় ঝলমল করে উঠে জলধারা আর স্পষ্ট হয়ে উঠে এঁকে বেঁকে যাওয়া অগভীর জলপথ। প্রায় দেড় ঘন্টা হাঁটার পর হঠাত দেখি একটা পথ চলে গেছে পাহাড়ের উপরে আরেকটা পথ ঝিরি ধরে আরও সামনে। সিদ্ধান্ত নিই উপরে উঠবো। পাহাড়ের মাঝখানে দিয়ে বেয়ে উঠা সাপের মত পথ দিয়ে হাঁটা শুরু করি। বেশ খাড়া পথ। এঁকে বেঁকে উঠে গেছে পাহাড়ের দিকে। কিছুদূর যেতেই দেখামেলে ছবির মতো আঁকা জুম ক্ষেতের দিকে। যেনো কোন শিল্পী থরে থরে সাজিয়ে দিয়েছে এই ধানক্ষেত। সবুজ ধান ক্ষেতের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলি আমরা। শরতের আকাশ ভেঙে হঠাত বৃষ্টি নামে। বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু হয়ে আমরা এগিয়ে যেতে থাকি একটু একটু করে। সবুজ বন, পাহাড় যেনো আরও সবুজ হয়ে যেতে থাকে বৃষ্টির ছোঁয়ায়। কিছুদর গিয়ে একটা জুম ঘরের দেখা মেলে। জুমঘর মূলত একটা অস্থায়ী ঘর যেটা পাহাড়ী কৃষক তৈরি করে ফসলের জন্য। সাধারণত তারা পাড়া থেকে বেশ দূরে কোন পাহাড়ে ফসল ফলায়। সেই পাহাড়ের ফসল বোনা, পরিচর্যা এবং তা সংগ্রহ করার জন্য জুমঘর তৈরি করা হয়। জুমঘরে ঢুকে ব্যাগিপ্যাক খুলে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে বসে পড়ি। বৃষ্টিতে ভেজা অবস্থায় গরম চা যেন এক আশ্চর্য শক্তি হিসেবে কাজ করে। জুম ঘর থেকে পথ ধরে আমরা এগুতে থাকি। জানিনা এই পথ আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে। ঠিক পাহাড়ের উপর একটা পাড়া। লালচে মাটিতে এলোমেলো ঘুরে বেরাচ্ছে বরাহশাবকেরা। পাড়ায় ১০/১২ টি পরিবার। আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন একজন, জানলান এখানে সাধারণত কেউ ঘুরতে আসেনা। কথা বলে বুঝতে পারলাম তিনি একজন ম্রো। অর্থাৎ এই পাড়াটি একটি ম্রো পাড়া। বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্যে ম্রো জাতিগোষ্ঠীই সবচাইতে প্রাচীন; এমনটাই ধারণা ইতিহাসবিদদের। শুধুমাত্র বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার সর্বত্রই নয়, বরং পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও ম্রো জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। সাধারণত, ম্রোদের মুরং নামেও ডাকা হয়। মুরং শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ম্রো থেকে, যার অর্থ মানুষ এবং মুরং অর্থ মানব সমাজ। আমরা পাড়া প্রধানের ঘরে যাই। ঘরে বাঁশের চাটাইয়ের মেঝে, দেয়ালও তাই আর ছনের চাল। বৃষ্টির মেটে গন্ধ ছড়িয়ে গেছে পুরো পাড়ায়। ব্যাগ গুলো রেখে আমরা বের হই চারপাশ ঘুরে দেখবো বলে। পাড়ার শেষ দিকে গেলে হঠাত শুনতে পাই ঝর্ণার শব্দ। পাড়া থেকে একটি ছেলে আমাদের নিয়ে চলে ঝর্ণা দেখাবে বলে। চাপাতি দিয়ে ঝোপ কাটতে কাটতে এগুই আমরা। জানতে পারি। এ ঝর্ণায় কোনো পর্যটক আসেনি। নতুন কিছু পাওয়ার আশায় আমরা আরও আগ্রহী হয়ে উঠি। ঘন্টাখানেক পর দেখা মিলে ঝর্ণার। এতো সুন্দর ঝর্ণা আমি বান্দরবানে খুব কমই দেখেছি। ঝর্ণার নাম জানতে চাইলে ছেলেটি জানালো এইখানে তিনিটি ঝর্ণা আছে। একটির নাম দরমুদ আর অন্য দুটির কোনো নাম নেই। অনিন্দ্য সুন্দর তিনটি ঝর্ণায় শরীর ভিজিয়ে নিতে নিতে ভাবি কি নাম দেয়া যায় তাদের। ঝর্ণার অবিরাম শব্দে সব হারিয়ে যায়। ধীরে ধীরে আলো কমে আসে। আবার পা বাড়াই পাড়ার দিকে। পাড়ার উঠানের একপাশে বাশ দিয়ে বানানো ছোট্র বসার জায়গা। আমরা সেখানে বসলে আমদের সাথে যোগ দেয় একদল ম্রো শিশু এবং একজন ম্রো যন্ত্রশিল্পী। আমাদের একজন চা বানাতে বসে যায়। অচেনা এক পাড়ায় আমরা দেখি যে দূরে সুর্য ডুবতে গিয়েও আটকে যাচ্ছে পাহাড়ের চূড়ায়। নীল পাহাড়গুলো যেনো হয়ে উঠেছে সুর্যের লুকোচুরি খেলার সাথী। এরই সাথে রহস্যের সুরে বেজে উঠেছে অসাধারণ ম্রো বাদ্যযন্ত্র প্লুং। ধীরে ধীরে সূর্য ডুবে যায়। মিলিয়ে যায় বাঁশির সুর। সন্ধ্যার আধারে নীলচে কালো পাহাড়ের মাঝে আটকে থাকি আমরা কয়েকজন যুবক আর এক ম্রো বাশিওয়ালা। আমরা ভাবতে থাকি, কী নাম দেবো ওই ঝর্ণা দুটির অথবা এই অপার্থিব সময়ের। আমাদের ভাবনা খুঁজে পায়না কিছুই। নামহীন হয়ে থাকে দুটি ঝর্ণা আর একটা গভীর সন্ধ্যা। ঢাকা থেকে আলীকদম ৮০০ টাকা, সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্ট এরিয়া বাইকে। তারপর ৩ ঘন্টার হাঁটা পথ। ওদের ঘরেই থাকা, খাওয়া প্রায় বিনা খরচে, তবে টুকিটাকি বাজার করে নিয়ে গেলে ভালো। বর্ষার পর পর যাওয়ার উপযুক্ত সময়। তাতে পুরোটা সৌন্দর্য ধরা পড়বে।

Already have an account?

Login to vote

Do not have an account?

Create Account to vote