bgc_photo_3642
 

প্রতিযোগীঃ Khairul Islam

রাজবাড়ি বলতে আসলে বোঝানো হয় রাজার বাড়িকে। তবে আমাদের দেশে খুব বেশি রাজবাড়ি নেই। কারণ সহজেই অনুমেয়। আমাদের দেশে আসলে এত রাজা ছিলেন না। অধিকাংশই ছিলেন জমিদার। সেই হিসেবে জমিদার বাড়ির সংখ্যা অনেক এই দেশে। তবে অনেক জমিদার তার কাজের জন্য রাজা হয়ে উঠেছিলেন। আজকে আমি যাবো এমনই এক রাজার বাড়িতে। তার নাম রাজা হরনাথ রায় চৌধুরী। সর্ব সাধারণের কাছে তিনি খুব পরিচিত নাম না হলেও নওগাঁবাসীদের জন্য খুবই পরিচিত নাম। সেই নামেই আজকে তার ইতিহাস খোঁজার যাত্রা। রাত ১১ টায় কল্যাণপুর থেকে এস আর পরিবহনের ১০০০ টাকার এসি বাসে উঠে পড়লাম। বাসে বসে বসে এই জমিদার বাড়ির ইতিহাস পড়তে লাগলাম। নভেম্বর মাস, কিন্তু ঢাকায় ঠাণ্ডা নেই বললেই চলে। মাঝে সিরাজগঞ্জ বাস যাত্রা বিরতি দিলো। বাইরে বের হয়েই বুঝলাম জ্যাকেট ছাড়া বের হওয়াটা একদম বোকামি হয়ে গেছে। এককাপ চা আর সিগারেট খেয়ে আবার বাসে গিয়ে বসলাম। চা খাওাতে যেনো ঘুম দ্রুত গতিতে চলে এসেছে। বাসে দেয়া কম্বল টেনে ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভেঙে দেখি বাস নওগাঁ এসে থেমেছে। ভোর ৫ টা প্রায়। বাইরে ঘন কুয়াশা এবং অন্ধকার কিছুই দেখা যায়না। ঘণ্টাখানেক বাস কাউন্টারে কাটিয়ে দিলাম। আর জেনে নিলাম জমিদার বাড়িতে যাবার উপায়। এবার ঘুরে দেখবো দুবলহাটি রাজবাড়ি, বলিহার রাজবাড়ি আর কুশুম্ভা মসজিদ। জমিদার বাড়ি হলেও এঁকে সবাই রাজবাড়ি হিসেবেই চেনে। দুবলহাটি রাজবাড়ি। নওগাঁ শহর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দক্ষিনে এই ইউনিয়নটি। মাঝখানে নওগাঁ শহরের বুক চিরে বয়ে গেছে ছোট যমুনা নদী। যদিও এখন তাকে দেখতে আর নদী মনে হয়না। বেশ কিছু বছ আগেও এই নদীর বুকে চলাচল করত বড় নৌকা, মালবাহী বড় বড় ট্রলার। এখন শুধু সরু এক জলধারা। যাইহোক সদরের বালিয়াডাঙ্গা বাস স্ট্যান্ড হতে ভ্যানে গেলাম দুবলহাটি রাজবাড়ী। জনপ্রতি ভাড়া ২০ টাকা। দুবলহাটি বাজারে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। বাজার পেরিয়ে বা দিকেই দেখা মিলল দুবলহাটি জমিদার বাড়ির বিশাল প্রবেশদ্বারের। ধ্বংসস্তুপের মতো টিকে আছে এক প্রকান্ড গাঁথুনি। পলেস্তরা খসা দেয়াল আর রোমান করিন্থিয়ান কলামের ভেতর থেকে বের হয়ে আছে লাল ইটের গাঁথুনি। জমিদার বাড়িটি প্রায় দুই’শ বছরের পুরোনো। বাংলাদেশের অন্যান্য জমিদার বাড়ির তুলনায় এটি বেশ বড়। কিন্তু অবস্থা খুবই শোচনীয়। তবু অবশিষ্ট দেখে সহজেই আন্দাজ করা যায় এর অতীত জৌলুস। এই জমিদার বাড়িতে প্রায় সাড়ে তিনশ’ ঘর ছিল, যা কালের বিবর্তনে আজ লুপ্ত হওয়ার পথে। মূল ফটকটি আর ব্যবহার করার উপযোগী না থাকায় ডান পাশের ঘরটি ব্যবহার করেই ভেতরে ঢুকতে হয়। এই জমিদার বাড়ি থেকেই তৎকালীন সিলেট, দিনাজপুর, পাবনা, বগুড়া, রংপুর ও ভারতের কিছু অংশের জমিদারি পরিচালিত হতো। ভেতরে ঢুকতেই মনে হলো অজানা কোনো রাজার রাজ্যে ঢুকে পড়েছি। ধ্বংসস্তুপের মতো দাঁড়িয়ে আছে ভবনগুলো, মনে হচ্ছে এই বুঝি এখনই আছড়ে পড়বে মাটিতে। প্রাসাদটি মোট সাতটি আঙ্গিনা ও প্রায় সড়ে তিনশ কক্ষ নিয়ে গঠিত। এর ভিতরের দালানগুলো তিন থেকে চার তলা বিশিষ্ট। রাজা রাজেশ্বরী নামে সেখানে একটি মন্দির রয়েছে যেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালানো হতো। বলা হয় এই বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা প্রায় প্রতিরাতে স্বপ্ন দেখতেন তাঁকে কে যেন বলছে, “তুই যেখানে নৌকা বেঁধেছিস সেখানে জলের নিচে রাজ রাজেশ্বরী দেবীর প্রতিমা আছে। সেখান থেকে তুলে স্থাপন কর।” একদিন ভোরবেলা জলে নেমে দেখলেন সত্যিই সেখানে রাজ রাজেশ্বরীর প্রতিমা আছে। তিনি প্রতিমাটি জল থেকে তুলে একটি মাটির বেদী তৈরি করে প্রতিষ্ঠা করলেন। সেই বিশাল স্থাপনার কোনো দরজা ও জানালা এখন আর নেই। সবকিছুই চুরি হয়ে গেছে। এমনকি লোকজন দালান থেকে ইটও খুলে নিয়ে চলেছে নিজের কাজে। এখনও লোহা আর কাঠের পাটাতনে গড়া একতলার আর দোতলার ছাদগুলো টিকে আছে। হয়তো আর কিছুদিন পর আর থাকবেনা। ভাঙা সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। উপরে প্রায় সবটুকুই ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। আরও একটা সিড়ি বেয়ে খোলা ছাদের উপর থেকে পুরো বাড়িটি একবার দেখে নিলাম। ১৭৯৩ সালে রাজা কৃষ্ণনাথ লর্ড কর্নওয়ালিসের কাছ থেকে ১৪ লাখ ৪ শত ৯৫ টাকায় জায়গাটি কিনে জমিদারী শুরু করেন। রাজা কৃষ্ণনাথের কোনো সন্তান বেঁচে না থাকায় তার নাতি রাজা হরনাথ রায় ১৮৫৩ সালে সেখানকার দায়িত্বভার গ্রহন করেন। তারপর এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে তিনি বিভিন্ন নাট্যশালা এবং স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেন। আর পুরোটাই একতা স্মৃতির দেয়ালে পরিণত হয়েছে। ১৮৯২ সালের দিকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর রাজা হরনাথ রায় সপরিবারে ভারতে চলে যান। পরবর্তীকালে এটি সরকারি সম্পদ হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের অধীনে চলে আসে। শীতের বিকেল নামে দ্রুত। আমিও ক্ষয়ে পড়া রাজবাড়ি দেখে দেখে ক্লান্ত। দুবলহাটি বাজারে খাওয়া দাওয়া করে পা বাড়ালাম বলিহার রাজবাড়ির পথে। ঘুরে দেখবো আরও একটি রাজবাড়ি এবং মসজিদ। তবে সে গল্প আরেকদিনের জন্য তোলা থাকলো। আপাতত চিন্তাজুড়ে থাক দুবলহাটির রাজবাড়ির গল্প।

Already have an account?

Login to vote

Do not have an account?

Create Account to vote